বরকত এক গাদা জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়েছে। ফ্লাস্ক আছে, চায়ের কাপ আছে, পানির বোতল আছে। মিসির আলির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ফ্লাস্ক ভর্তি চা থাকলেও তিনি যে ব্রাত জাগিবেন এবং চা খাবেন তা মনে হচ্ছে না। বরকত পাশে পাশে হাঁটছে। মনে হচ্ছে তার হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
নতুন যে ঘরে মিসির আলিকে থাকতে দেয়া হয়েছে সে ঘরটাও প্রায় আগেরটার মতোই বড়। তবে আসবাবপত্র নেই। ঘরের মাঝখানে কালো রঙের খাট। খাটের পাশেই ছোট্ট টেবিল। টেবিলে হারিকেন আছে, একটা কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প আছে, দেয়াশলাই এবং মোমবাতিও রাখা আছে। ঘুমের অষ্ণুধ রাখা হয়েছে, এক ধরনের নয়–বেশ কয়েক ধরনের। The Other Mind বইটি রাখা হয়েছে বিছানায় বালিশের উপর।
শোবার আগে বই পড়া মিসির আলির অনেক দিনের অভ্যাস। পড়ার বই তিনি সঙ্গে এনেছেন। বাইরে বেড়াতে গেলে হালকা ধরনের বইপত্র পড়তেই ভালো লাগে। সাইকোলজির কঠিন বই না। কিন্তু এ বাড়ির কর্তা যে কোনো কারণেই হোক চাচ্ছে যেন তিনি The other Mind বইটি পড়েন। আজ পড়া যাবে না, কারণ ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে छान्छ।
মিসির আলি দরজার ছিটিকিনি লাগাতে গেলেন। জং ধরে ছিটিকিনি আটকে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও ছিটিকিনি লাগাতে পারলেন না। লাভের মধ্যে লাভ এই হল যে ঘুম কেটে গেল। মিসির আলি ডায়েরি বের করলেন-কয়েক পৃষ্ঠা লিখবেন। এতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হবে। তারপর বই নিয়ে বসবেন। সাইকোলজির কঠিন বই না, জেরোম কে জেরোমের এক নায়ে তিনজন।
টেবিলে যদিও দুটা বাতি তারপরেও এই আলো লেখার জন্যে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। মিসির আলি লিখে আরাম পাচ্ছেন না। এক সময় তার মনে হল শুধু যে আলোর অভাবেই তিনি লিখে আরাম পাচ্ছেন না, তা না। যে বিষয় নিয়ে লিখছেন সেই বিষয়টি লিখতেও ভালো লাগছে না। মনের ভেতরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
এখন রাত একটা কুড়ি। আমার অনেকদিনের অভ্যাস ঘুমুতে যাবার আগে হয়। কিছুক্ষণ লিখি, নয় বই পড়ি। লাল মলাটের এই ডায়েরিটা আমি কিনেছিলাম নির্জন সমুদ্রবাসের অভিজ্ঞতা লেখার জন্যে। সমুদ্রবাস এই মুহুর্তে করতে না পারলেও নির্জনবাস ঠিকই করছি। যাদের বাড়িতে আমি আছি তারা আমাকে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে কিন্তু আমি কেন যেন ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না। আমার শুধুই মনে হচ্ছে— কোথাও একটা সমস্যা আছে। আমি সমস্যা ধরতে পারছি না। সমস্যার নিয়ম হল–সমস্যাটা যদি এমন হয় যে খুবই স্পষ্ট তাহলে সেই সমস্যা ধরা যায় না। ধরতে সময় লাগে।
এরা খুব আগ্রহ করে আমাকে এই বাড়িতে এনেছে। আগ্রহের পেছনের কারণটা কী? আমাকে আকাশের তারা দেখানোর জন্যে কিংবা ভালো ভালো খাবার রান্না করে খাওয়াবার জন্যে নিশ্চয়ই আনে নি। আমি অতি বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি না যে এ বাড়িতে কিছুদিন থেকে গেলে এদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এরা বলতে পারবেআমাদের সঙ্গে মিসির আলি কিছুদিন ছিলেন। তিনি আমাদের অতি বন্ধু মানুষ। প্রায়ই আসেন। আগামী সামারে আবার আসবেন। এই দেখুন। মিসির আলির সঙ্গে আমাদের ছবি।
সুলতান বা তার স্ত্রী আমার কাছ থেকে ঠিক কী চাচ্ছে তা এখনো ধরতে পারছি না। বলে আমার অস্বস্তিটা কাটছে না। তারা কোনো বিপদে আছে বলে আমার মনে হয় না। বিপদে থাকলে প্রথম রাতেই বিপদের কথা জানতে পারতাম। এদের আচার-আচরণে সামান্য অস্বাভাবিকতা আছে এটা থাকবেই। একটা বিশাল পঁচিল ঘেরা বাড়িতে দিনের পর দিন যদি তিনটি মানুষ বাস করে তাহলে তাদের চরিত্রে পরিবেশের প্রভাব প্রবলভাবে পড়বে। পরিবারের প্রধান মানুষটি হুইল চেয়ারে জীবন যাপন করছেন। এর প্রভাবও বাকিদের উপর পড়বে। আফ্রিকার আদিবাসি এক জনগোষ্ঠীর উপর একবার একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেখা গেল এরা সবাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কারণ অনুসন্ধান করে পাওয়া গেল। এদের দলপতি বা পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। ব্যথার কারণে সারাজীবন তাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছে। তাই সংক্রমিত হয়েছে পুরো দলের উপর।
আমি এ বাড়ির তিন সদস্যকে আলাদা আলাদাভাবে দেখার চেষ্টা করছি, আবার দলবদ্ধভাবেও দেখার চেষ্টা করছি। সুলতানকে আমার মনে হয়েছে আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। আমি যা করছি ঠিক করছি, আমি যা ভাবছি ঠিক ভাবছি গোত্রের একজন। একই ব্যাপার লিলির মধ্যে এবং বরকতের মধ্যেও দেখলাম। দীর্ঘদিন কিছু মানুষ যদি একটি গণ্ডিতে বাস করে তাহলে একটা পর্যায়ে তারা তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। এদের ক্ষেত্রেও কি তাই হতে যাচ্ছে?
সুলতানের আট ধরনের মধু এবং মধুনিয়ে তার বাড়াবাড়ি উচ্ছাসের কারণটা ধরতে পারছি না। যারা মধ্যপান করেন এবং ভালো মদের ব্যাপারে যাদের আগ্রহ আছে তাদের মধ্যে এই উচ্ছাস দেখা যায়। নানান ধরনের মাদ সংগ্ৰহ করতে এবং অতিথিদের তা দেখাতে এরা পছন্দ করেন। সুলতানের মধুর ব্যাপারটা শুরুতে আমি সে রকম কিছুই ভেবেছিলাম। পরে লক্ষ করলাম ব্যাপারটা সে রকম না। আমি নিশ্চিত যে সুলতান মধু খায় না। কারণ সে যখন আমাকে মধু দিচ্ছিল তখন তার নাক এবং ভুরু সামান্য কুঞ্চিত হল। যে তঁটকি কখনো খায় না। তার সামনে এক বাটি শুটকির ঝোল দিলে সে এই ভঙ্গিতেই নাক কুঁচকাবে। আমি একবার ভেবেছিলাম তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি সে মধু খায় কি না। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করি নি। আমি যে চোখ খোলা রেখে সব দেখছি তা ঠিক এই মুহূর্তে এদের জানতে দিতে চাচ্ছি না। বরকত নামের দারোয়ানের একটা বিষয় আমার চোখে লাগছে। আমি লক্ষ করেছি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে তার খুবই কষ্ট হয়। দেখে মনে হয় কষ্টটা শারীরিক। আমার ধারণা তা না। আমার ধারণা কষ্টটা মানসিক। দোতলার কোনো ভয়ঙ্কর স্মৃতি কি তার মাথায় আছে? যে কারণে দোতলায় ওঠার ব্যাপারে তার অনাগ্ৰহ আছে?