খাবার আয়োজন বেশি না। আলু ভাজা, মুগের ডাল, করলা ভাজি, বেগুন ভাজি, সজনের ঝোল, পটেলের ঝোল এবং ডাল। সবই নিরামিষ! একটা বাটিতে ঘি, অন্য একটা বাটিতে তেঁতুলের আচার। মিসির আলি অত্যন্ত তৃপ্তি করে খেলেন। লিলি মেয়েটির রান্নার হাত যে অসাধারণ-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। এত অল্প সময়ে এতগুলি পদ সামনে দেওয়া সহজ ব্যাপার না। মেয়েটার অসুস্থতার ব্যাপারটি এখনো মিসির আলির কাছে পরিষ্কার হয় নি। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটাকে যে কোনো কারণেই হোক তার সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে না, কিংবা সে নিজেই আসছে না। এই মুহুর্তে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না।
মিসির আলি খাওয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই সুলতান ঢুকল। তার হাতে কাচের মুখ খোলা বিয়াম এবং একটা চামচ। সে কি আড়াল থেকে মিসির আলির খাওয়া দেখছিল? তা না হলে খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র তার উপস্থিত হওয়াটা সম্ভব না।
স্যার আপনার ডেজার্ট। অনেক রকম ডেজার্ট খেয়েছেন, এটাও খেয়ে দেখুন। আপনাকে মেপে মেপে দু চামচ দেব। দু চামচের বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। তবে আপনার যদি আরো খেতে ইচ্ছে করে, তাহলে খাবেন! সাধারণত দু চামচের বেশি। খেতে ইচ্ছা করে মা।
সোনালি রঙের ঘন তরল পদার্থ। হারিকেনের আলোয় ঝিকঝিক করে জুলছে। সুলতান বলল, তর্জনীতে মাখিয়ে মাখিয়ে মুখে দিল। এইভাবেই খাওয়ার নিয়ম।
মিসির আলি বললেন, জিনিসটা কি মধু?
জি মধু।
বিশেষ কোনো মধু? অবশ্যই বিশেষ মধু। চাকভঙা মধু এই বাক্যটা নিশ্চয়ই শুনেছেন। এটা হল চাকভঙা মধু। সুন্দরবনের মধুয়ালীরা মার্চ-এপ্রিল মাসে এই মধু সংগ্রহ করে। এই সময় খলিসা ফুল ফুটে। মৌমাছিরা খলসা ফুল থেকে মধু জমা করে। কেওড়া ফুলের মধুও আছে। সেটাও খারাপ না। তবে খলসা ফুলের মতো ভালো মধু পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমি মনে করি না।
মিসির আলি আঙুলে মধু মাখিয়ে মুখে দিলেন। তিনি বিশেষ কোনো পার্থক্য অনুভব করতে পারলেন না। ঘন মিষ্টি সিরাপে হালকা ফুলের গন্ধ।
অন্য মধুর সঙ্গে পার্থক্য বুঝতে পারছেন?
না। মধু আমি খাই না। যারা নিয়মিত খায় তারা হয়তো পার্থক্যটা ধরতে পারবে। আমি পারব না।
আপনিও পারবেন। আমার কাছে এই মুহুর্তে আট রকমের মধু আছে। অস্ট্রেলিয়ান মধু, কানাডার মধু, আয়ারল্যান্ডের মধু এবং পাঁচ রকমের সুন্দরবনের মধু। সব আপনাকে খাওয়াব। আপনি নিজেই পার্থক্য ধরতে পারবেন। আপনি যখন এ বাড়ি থেকে বিদায় নেবেন তখন আপনি মোটামুটিভাবে একজন মধু বিশেষজ্ঞ।
মিসির আলি মধু শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন।
সুলতান বলল, যান শুয়ে পড়ুন। সকালবেলা নাশতা খেতে খেতে আগামী কয়েক দিনের প্রোগ্রাম সেট করে ফেলব।
আচ্ছা।
পান খাবার অভ্যাস আছে?
না।
কাঁচা সুপারি দিয়ে একটা পান খেয়ে দেখুন। কাঁচা সুপারিতে এলকালয়েড আছে। এই এলকালয়েড স্নায়ুর উপর কাজ করে। শরীরে হালকা ঝিমঝিম ভাব নিয়ে আসে। ইন্টারেস্ট্রিং সেনসেশন।
মিসির আলি কাঁচা সুপারির একটা পান মুখে দিলেন!। সুলতান বলল, আপনার ঘর পান্টে দিয়েছি। কার্বলিক এসিডের গন্ধ আপনার কাছে বিরক্তিকর এটা জানতাম না। এই ঘরটায় কাৰ্বলিক এসিড দেওয়া হয় নি।
দোতলায় সাপ কি সত্যি আছে?
থাকার কোনোই কারণ নেই। তবে সাপ দেখা গেছে। আমি নিজেই দেখেছি। আমি সাপ চিনি না। যেটাকে দেখেছি তার ফণা আছে। কাজেই বিষ থাকার কথা।
বলেন কী?
আপনার খাটটা ঠিক ঘরের মাঝখানে দিতে বলেছি। খাটের নিচে জ্বলন্ত হারিকেন থাকবে। সাপ কাৰ্বলিক এসিডের চেয়েও বেশি ভয় পায় আলো। মশা নেই, তবু মশারি খাটিয়ে ঘুমাবেন। বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলে ভালোমতো মেঝে দেখে তারপর নামবেন। আপনার কি ভয় লাগছে?
সামান্য লাগছে। সাপ আমার পছন্দের প্রাণী না।
আমার নিজেরও না। আমি এই পৃথিবীতে একটা জিনিসই ভয় পাই। তার নাম সাপ। মানুষ নানান রকম দুঃস্বপ্ন দেখে, আমি একটা দুঃস্বপ্নই দেখি-আমি সাপের সঙ্গে শুয়ে আছি। বেশ স্বাভাবিকভাবেই শুয়ে আছি। স্বপ্নটা দেখার সময় ভয় লাগে না। স্বপ্নটা যখন ভেঙে যায় তখন প্রচণ্ড ভয় লাগে। গা ঘিন ঘন করতে থাকে। বারবার গোসল করি, তারপরেও মনে হয় সাপের স্পৰ্শ শরীরে লেগে আছে। আপনার সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে পরে কথা বলব।
আচ্ছা।
আমি দোতলা পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দিতে পারছি না। ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব না। হুইল চেয়ার দোতলায় ওঠাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। বরকত আপনাকে নতুন ঘর দেখিয়ে দেবে।
এত বড় বাড়িতে আপনারা তিন জন মাত্র মানুষ!
আমরা ছয় জন ছিলাম! এখন তিন জন। জানি করে এসেছেন। আপনি ক্লান্ত। শুয়ে পড়ুন। কাল আপনার সঙ্গে কথা হবে। আমার উচিত ছিল ঘর পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দেওয়া, সেটা সম্ভব না। বরকত এগিয়ে দেবে।
কোনো অসুবিধা নেই।
বরকতের অনিদ্রা রোগ আছে। সে কুকুরগুলির সঙ্গে সারারাত জেগে থাকে। আপনার যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়-সিঁড়ির কাছে এসে ওকে ডাকলেই হবে।
থ্যাংক য়্যু।
নতুন জায়গায় ঘুম যদি না আসে তার জন্যে আপনার ঘরে ফ্রিজিয়াম জাতীয় কিছু ট্যাবলেট দিতে বলেছি। লিলি নিশ্চয়ই দিয়েছে। রাত জেগে যদি বই পড়তে চান তার ব্যবস্থাও করেছি। The other Mind বইটাও আপনার বিছানার কাছে আছে। বইটা কি পড়েছেন?
না।
পাঁচ জন সিরিয়াল কিলারের মানসিকতা ব্যাখ্যা করে বইটা লেখা হয়েছে। আমি নিজে খুবই আগ্রহ করে বইটা পড়েছি। আপনার অনেক বেশি ভালো লাগবে বলে আমার ধারণা।