হুইল চেয়ারে বসে যে মানুষটি হাত বাড়িয়েছে মিসির আলি কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। কাছাকাছি আসায় মানুষটাকে এখন দেখা যাচ্ছে। কেউ একজন একতলার দরজাও মনে হয় খুলেছে। আলো এসে পড়েছে মানুষটার মুখে। অত্যন্ত সুপুরুষ একজন মানুষ। অতিথিকে স্বাগতম বলার জন্যে যিনি বিশেষভাবে পোশাক পরেছেন। ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা প্যান্টের সঙ্গে, হালকা নীল ফুল হাফ শার্ট। পোশাকটায় স্কুল-ড্রেস স্কুল-ড্রেস ভাব আছে। কিন্তু এই মানুষটাকে খুব মানিয়েছে। ভদ্রলোক চশমা পরেন, নাকের কাছে চশমার দাগ আছে, কিন্তু এখন চোখে চশমা নেই। তাঁর বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ, বুদ্ধিতে ঝিকমিক করছে। বয়স পঞ্চাশের বেশি। মাথা ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল। কাঁচা-পাকা চুলের যে আশ্চর্য সৌন্দৰ্য আছে, তা এই মানুষটার চুলের দিকে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়।
স্যার আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। আপনি কেমন আছেন?
আমি ভালো আছি।
ঘরটা পছন্দ হয়েছে?
কার্বলিক এসিড দেওয়ার আগ পর্যন্ত পছন্দ ছিল। আমার কিছু গন্ধবিষয়ক সমস্যা বোঝা যায়।
আপনি এসেছেন। আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি। খুশির প্রকাশটা অবিশ্যি করতে পারছি না। আপনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ, আপনি নিশ্চয়ই আমার খুশি ধরতে পারছেন।
মিসির আলি কিছু বললেন না। মানুষটা যে খুশি হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে। আনন্দিত মানুষের ভেতর অস্থিরতা থাকে। ব্যথিত মানুষ চুপচাপ হয়ে যায়। এই মানুষটা অস্থির। হুইল চেয়ার নিয়ে এদিক-ওদিক করছে।
আমি আপনাকে খাবার ঘরে নিয়ে যাবার জন্যে অনেকক্ষণ থেকে সিঁড়ির গোড়ায় বসে আছি। আপনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি নিচ থেকে আপনাকে লক্ষ করছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল কোনো একটা বিষয় নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করছিলেন। দুশ্চিন্তার বিষয়টা ধরার চেষ্টা করছিলাম।
দুশ্চিন্তা করছিলাম না। আপনার স্ত্রী লিলি কোথায়?
ও রান্না শেষ করে ঘুমুতে চলে গেছে। ভুল বললাম, সে চলে যায় নি। আমি তাকে জোর করে পাঠিয়েছি। ওর কিছু মানসিক সমস্যা আছে। সমস্যাগুলি হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয়। আপনাকে নানান কৌশল করে এখানে আনার অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটা কারণ হল লিলির ব্যাপারটি নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করা।
ও আচ্ছা।
স্যার আসুন। খেতে আসুন। খাবার ঘরটা একতলায়। একতলায় থাকায় রক্ষা। আমি যেতে পারছি। দোতলায় হলে যেতে পারতাম না।
মিসির আলি ভেবেছিলেন বিশাল একটা খাবার ঘর দেখবেন। তা দেখলেন না। ছোট ঘর। খাবার টেবিলটাও ছোট। টেবিলের পাশে একটা মাত্র চেয়ার। মনে হচ্ছে একজনের জন্যেই খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ঘরের প্রধান আকর্ষণ মোমদানি। রূপার তৈরি মোমদানিতে এক সঙ্গে একুশটা মোম জুলছে। ঘর আলো হয়ে আছে। মোমদানিটা খাবার টেবিলে রাখা।
মিসির আলি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আপনি খাবেন না?
জি না। সন্ধ্যার পর আমি কিছু খাই না। আগে পানি, চা-কফি খেতাম। এখন তাও না। সূর্য ড়ুবল মানে আমার খাওয়ার পর্ব শেষ।
মিসির আলি একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন–সূৰ্য ডোবার পর কেন খান না? শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করলেন না। সূৰ্য ডোবার পর খাদ্য গ্ৰহণ না করার পেছনে অদ্রলোকের নিশ্চয়ই কিছু যুক্তি আছে। সেইসব যুক্তি তিনি যদি অন্যদের জানাতে চান-প্রশ্ন না করলেও জানাবেন।
সূৰ্য ডোবার পর আমি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি কেন জানেন?
না জানি না।
সরি, আমি আপনাকে খুবই বোকার মতো প্রশ্নটা করলাম। সন্ধ্যার পর আমি কেন কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করি না সেটা তো আপনার জানার কথা না। তবে আপনার লজিকেল ডিডাকসানের যে ক্ষমতা আপনি নিশ্চয়ই বের করে ফেলেছেন?
আমি কিছু বের করি নি।
স্যার আপনি খাওয়া শুরু করুন। সব টেবিলে দেওয়া আছে। আপনি খেতে থাকুন। আমি গল্পটা বলি। এক রাতে খেতে বসেছিঃ হঠাৎ মনে হল-পৃথিবীর পশুপাখি কীটপতঙ্গ কোনো কিছুই রাতে খাদ্য গ্ৰহণ করে না। জীব জগতের নিয়মই হল রাতে খাদ্য গ্ৰহণ না করা। এমনকি উদ্ভিদও সূর্যের আলো নিয়ে খাদ্য তৈরি করে দিনে, রাতে না। আর আমরা মানুষরা জীব জগতের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে রাতে খাদ্য গ্রহণ করছি। এটা তো ঠিক হচ্ছে না। তারপর থেকে সূর্য ডোবার পর ফুড ইনট্রেক পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। প্রথম কিছুদিন কষ্ট হয়েছে। এখন আর হচ্ছে না। এখন ভালো আছি। শরীর খুবই ফিট। যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই গল্প বলার ছলে বলতে চেষ্টা করি–সূৰ্য ডোবার পর খাদ্য গ্রহণ করা ঠিক না। মিসির আলি প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন, জীব জগতের কেউই রাতে খাবার খায় না?
বাদুড় আর পেঁচা খায়। এরা নিশাচর-এদেরটা হিসেবে ধরছি না। আমি যে বকবক করছি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো?
বিরক্ত হচ্ছি না।
প্রথম দফাতে অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি। আর করব না। আপনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিশ্ৰাম করুন। আমি বইয়ে পড়েছি আপনি একা খেতে পছন্দ করেন। সবকিছু দেওয়া আছে। আপনি খান। আমি পাশের ঘরেই থাকব। কোনো দরকার হলে ছাকবেন।
মিসির আলি বিব্রত গলায় বললেন, আমার একা খাওয়াটা কোনো নিয়মের কারণে না। একা থাকি বলেই এক খাই।
একা খেয়ে আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে। হঠাৎ করে এই অভ্যাস ভাঙানো ঠিক হবে না। আপনি খাওয়া শেষ করুন—তখন শুভরাত্রি জানানোর জন্য আসব। আপনাকে খুব স্পেশাল ডেজার্টও খাওয়াব।