- বইয়ের নামঃ আমিই মিসির আলি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, দর্শন, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
আপনিই মিসির আলি
আপনিই মিসির আলি?
হ্যাঁ।
মেয়েটা এমনভাবে তাকাল যেন সে নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলা থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি ভীষণ জরুরি একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। চিঠিটা এই মুহূর্তে আপনাকে না দিয়ে একটু পরে দেই? নিজেকে সামলে নেই। আমি মনে মনে আপনার চেহারা যেমন হবে ভেবেছিলাম, অবিকল সে রকম হয়েছে।
মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকালেন। সরল ধরনের মুখ। যে মুখ অল্পতেই বিস্মিত হয়। বারান্দায় চড়ুই বসলে অবাক হয়ে বলে, ও মাগো কী অদ্ভুত একটা চড়ুই! মেয়েটার সুন্দর চেহারা। মাথার চুল লালচে এবং কোঁকড়ানো না হলে আরো সুন্দর লাগত। বয়স কত হবে-পঁচিশ ছাব্বিশ। নাকি আরো কম? কপালে টিপ দিয়েছে, টিপটা ঠিক মাঝখানে হয় নি। বঁটা দিকে সরে আছে। মেয়েরা সাধারণত টিপ দেওয়ার ব্যাপারে খুব সাবধানী হয়। টিপ এক পাশে হলে কপালে সতীন জোটে-তাই বাড়তি সাবধানতা। এই মেয়েটা হয়তো তেমন সাবধানী নয়, কিংবা এই গ্ৰাম্য কুসংস্কারটা জানে না। মেয়েটা চোখে কাজল দিয়েছে। গায়ের রঙ অতিরিক্ত সাদা বলেই চোখের কাজলটা ফুটে বের হয়েছে। শ্যামলা মেয়েদের চোখেই কাজল মানায়, ফৰ্মা মেয়েদের মানায় না। তার পরেও এই মেয়েটিকে কেন জানি মানিয়ে গেছে।
সে পরেছে সবুজ রঙের শাড়ি। এখনকার মেয়েরা কি সবুজ রঙটা বেশি পরছে? প্রায়ই তিনি সবুজ রঙের শাড়ি পরা তরুণীদের দেখেন।…আগে শহরের মেয়েরা সবুজ শাড়ি এত পর্যন্ত না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের রঙের পছন্দ কি বদলাচ্ছে? রঙ নিয়ে কোনো গবেষণা কি হয়েছে? র্যানডম স্যাম্পলিং করা যেতে পারে। প্রতিদিন পঞ্চাশটা করে মেয়ের শাড়ির রঙ দেখা হবে। একেক দিন একেক জায়গায়। আজ নিউমার্কেটে, কাল গুলিস্তানে, পরশু। ধানমণ্ডি। পরীক্ষাটা একমাস ধরে করা হবে। তারপর করা হবে। গসিয়ান কার্ড।
মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। পরীক্ষাটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে তত সহজ হবে। না। স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেল দাঁড় করানো কঠিন হবে। মূল গ্রুপের ভেতর থাকবে সাব গ্রুপ। বিবাহিত মেয়ে, অবিবাহিত মেয়ে। উনিশ বছরের কম বয়সী মেয়ে, উনিশ বছরের চেয়ে বেশি বয়সের মেয়ে, ডিভোর্সড মেয়ে, বিধবা মেয়ে।
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, মনে হচ্ছে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আপনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন? কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন?
মিসির আলি বললেন, দুশ্চিন্তা করছি না তো।
আপনি অবশ্যই দুশ্চিন্তা করছেন। দুশ্চিন্তা না করলেও চিন্তা করছেন। কেউ যখন গভীর কিছু নিয়ে চিন্তা করে-তখন বোঝা যায়।
তুমি বুঝতে পার?
হ্যাঁ পারি। ও আচ্ছা, আমি তো পরিচয়ই দেই নি। আপনি বসতে বলার আগেই বসে পড়েছি। আমার ডাক নাম লিলি! ভালো নামটা আপনাকে বলব না। ভালো নামটা খুবই পুরোনো টাইপ। দাদি নানিদের সময়কার নাম। এখন বলতে লজ্জা লাগছে।
মিসির আলি বললেন, পুরোনো জিনিস তো আবার ফিরে আসছে। পুরোনো প্যাটার্নের গয়নাকে এখন খুব আধুনিক ভাবা হচ্ছে।
যত আধুনিকই ভাবা হোক, আমার ভালো নামটাকে কেউ কখনো আধুনিক ভাববে না। আচ্ছা আপনাকে বলে ফেলি, আপনি কিন্তু হাসতে পারবেন না।
আমি হাসব না। আমি খুব সহজে হাসতে পারি না।
আমার ভালো নাম হল মারহাবা খাতুন। নামটার একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা আরেকদিন বলব। ইতিহাসটা শুনলে এখন নামটা আপনার কাছে যতটা খারাপ লাগছে– তাত খারাপ লাগবে না। তখন মনে হবে এই নামও চলতে পারে।
এখনো যে নামটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে তা না।
আপনার খারাপ লাগছে তো বটেই। আপনি ভদ্রতা করে বলছেন খারাপ না। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে মানুষ হিসেবে আপনি অত্যন্ত ভদ্র। কাউকে মনে আঘাত দিয়ে আপনি কথা বলতে পারেন না।
কীভাবে বুঝলে?
এই যে আমি বকবক করে যাচ্ছি, আপনি মনে মনে খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই সেটা প্রকাশ করছেন না। আপনি নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে অন্য কিছু ভাবছেন। আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি আমার বকবকানিতে বিরক্ত হচ্ছেন না?
মিসির আলি জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন। তিনি যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন।
একটা বয়স পর্যন্ত হয়তো মেয়েদের অকারণ অর্থহীন কথা শুনতে ভালো লাগে, তারপর আর লাগে না। এই মেয়েটি অকারণে কথা বলেই যাচ্ছে। মেয়েটার মনে গোপন কোনো টেনশন কি আছে? টেনশনের সময় ছেলেরা কম কথা বলে, মেয়েরা বলে বেশি। একটা ভালো দিক হচ্ছে মেয়েটার গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। কথা শুনতে ভালো লাগে। এর গলার স্বর একঘেয়ে হলে এতক্ষণে মাথা ধরে যেত।
বেলা বারোটার মতো বাজে। মিসির আলিকে নিউমার্কেট যেতে হবে। একটা কেরোসিনের চুলা সেই সঙ্গে আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনবেন। সমুদ্রতীরে নিরিবিলিতে কিছুদিন থাকার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। তাঁর এক ছাত্র বিনোদ চক্রবর্তী টেকনাফে কী একটা এনজিওতে কাজ করে। সে দিন পনের সমুদ্রের পাড়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জায়গাটার নাম কাদাডাঙ্গা। এমন একটা জায়গা যার আশেপাশের দুতিন মাইলের ভেতর কোনো লোকালয় নেই। সামনে সমুদ্র, পেছনে জঙ্গল। দিনরাত সমুদ্র দেখা, নিজে রান্না করে খাওয়া। ভাবতেই অন্য রকম লাগছে। সমুদ্র দর্শন উপলক্ষে কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। আজই তা শুরু করার কথা। মেয়েটির জন্যে সম্ভব হচ্ছে না। কারো মুখের উপর বলা যায় না, তুমি চলে যাও, আমার জরুরি কাজ আছে। মিসির আলির কাজটা তেমন জরুরিও না। কেরোসিনের চুলা বিকেলেও কেনা যায়। সন্ধ্যার পরেও কেনা যায়।