উনি আমাকে চেনেন?
হ্যাঁ চেনেন। আমি যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি তা তিনি জাসেন। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী।
যে দুজন খুন হয়েছে, তারা কারা?
একজন সর্দার চাচা। অন্যজন আমার বাবা।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। মুশফেকুর রহমান বলল, আপনি কি আমার স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন?
না।
না কেন?
একজন এসে আমাকে বলবে–তার বাড়িতে একটি প্ৰেতাত্মা বাস করছে, সেই প্ৰেতাত্মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়–আর ওমনি আমি কথা বলার জন্যে রওনা হব–তা হয় না। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, মানসিকভাবে অসুস্থ নই।
আপনি কি কোনো কৌতূহল বোধ করছেন না?
প্রেতাত্মা বিষয়ে কোনো কৌতূহল বোধ করছি না। তবে আপনার ব্যাপারে কৌতূহল বোধ করছি। আমার মনে হচ্ছে আপনি খুবই অসুস্থ একজন মানুষ। আপনার মার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। উনি কি জীবিত আছেন?
জি, জীবিত আছেন। আমি জানতাম। আপনি আমার মার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। আমি উনার ঠিকানা লিখে এনেছি। এই কাগজে লেখা আছে।
মিসির আলি যন্ত্রের মতো ঠিকানা লেখা কাগজ হাতে নিলেন।
ভদ্রমহিলার নাম মোমেনা খাতুন
ভদ্রমহিলার নাম মোমেনা খাতুন।
১৮/২ তল্লাবাগে তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন। টেলিফোন নাম্বার দেওয়া আছে। মিসির আলি অনেকবার টেলিফোন করলেন। রিং হয়। কিন্তু কেউ ধরে না। সেট হয়তো নষ্ট হয়ে আছে। নম্বর খুঁজে বাড়ি বের করার কাজটা তিনি একেবারেই পারেন। না। তিনি জানেন তন্ত্রাবাগে উপস্থিত হয়ে যদি বলেন, ১৮/২ বাড়িটা কোথায়, তা হলেও কোনো লাভ হবে না। যাকে জিজ্ঞেস করা হবে সে এমনভাবে তাকাবে যে এই নাম্বার শুনে সে বড়ই চমৎকৃত বোধ করছে। এমন অদ্ভুত নাম্বার কোত্থেকে এসেছে বুঝতে পারছে না। আরেক দল আছে যারা নাম্বার শুনে বলবে-ও আচ্ছা, আঠার বাই দুই। নাক বরাবর যান, তারপর লেফটে যাবেন। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে। এরা সবজান্তার কাজটা করে কিছু না জেনে। অন্যকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পেতে চায়।
এলাকার বাড়িঘরের নম্বর সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। যারা থ্রি-ফোরে পড়ে। মানুষের মতো বাড়ির নাম্বার আছে-এই বিষয়টি তাদের হয়তো আলোড়িত করে। তারা মনে রাখার চেষ্টা করে। বাড়ির নাম্বার নিয়ে বিব্রত মানুষকে সত্যিকার অর্থেই এর সাহায্য করতে চায়।
এদের একজনের সাহায্য নিয়েই মিসির আলি ১৮/২ তল্লাবাগ খুঁজে বের করলেন। সরু রাস্তার উপর বিরাট বাড়ি। বাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে সবই বড় বড়। ড্রয়িংক্রিমে বিশাল আকৃতির সোফা। দেয়ালে কাবা শরিফের প্রকাণ্ড বাঁধাই ছবি। একটি টিভি আছে-একে কত ইঞ্চি টিভি বলে কে জানে। সিনেমার পর্দার মতো বড় স্ক্রিন। শুধু বাড়ির দরজা-জানালা ছোট ছোট। প্রথম দর্শনেই মিসির আলির মনে হল-সোফা, টিভি এগুলো এ বাড়িতে ঢোকাল কীভাবে?
ড্রয়িংরুমে বেশকিছু লোক। গাদাগাদি করে সোফায় বসে আছে। বাড়িতে কোনো উৎসব হয়তো। সবাই সেজেগুঁজে আছে। অল্পবয়সী বালিকারাও ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে গালে রোজ মেখে সেজেছে। সবাইকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
মিসির আলির মনে হল মোমেনা খাতুন নামের এই বৃদ্ধ মহিলার প্রতি কারো কোনো কৌতূহল নেই। আগ্রহও নেই। একজন অপরিচিত ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শুনেও কেউ কোনো গা করছে না। মধ্যবয়স্ক এক লোক বিরস মুখে থললেন, বসুন দেখছি।
বলেই তিনি কর্ডলেস টেলিফোনে কাকে যেন ধমকাতে লাগলেন। লোকটার পরনে হালকা কমলা রঙের স্যুট। গলায় ছোট ছোট ফুল আঁকা টাই-তবে তার প্যান্টের জিাপার খোলা। সবাই তা দেখছে, কেউ কিছু বলছে না। মনে হয় বলার সাহস পাচ্ছে না।
মিসির আলি সোফায় বসে রইলেন একা একা। আঠার-উনিশ বছরের একটা মেয়ে ঝড়ের গতিতে বসার ঘরে ঢুকে মিসির আলিকে বলল-আপনি কি কার রেন্টাল থেকে এসেছেন? এত দেরি যে? বলেই জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করে ভেতরে চলে গেল। উঁচু গলায় বলল, বাস চলে এসেছে মা।
বোঝা যাচ্ছে এরা দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছে। পিকনিক হবার সম্ভাবনা। শীতকালের শুক্রবারে পিকনিক লেগেই থাকে। পিকনিক হলে মোমেনা খাতুনের দলটির সঙ্গে যাবার কথা! ইচ্ছা না থাকলেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পিকনিকে নিয়ে যেতে হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও
টেলিফোন হাতে ভদ্রলোক কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন এবং একটি কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বলছেন। একসময় লাইন কেটে গেল কিংবা ওপাশের অরলোক লাইন ছেড়ে দিলেন। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। মিসির আলি আবার বললেন, আমি একটু মোমেনা খাতুনের সঙ্গে কথা বলব।
আপনাকে অপেক্ষা করতে বললাম না। ব্যস্ততাটা তো দেখতে পাচ্ছেন? নাকি পাচ্ছেন না। সবাই গায়ে-হলুদে যাচ্ছে।
কিছু মনে করবেন না। আপনার প্যান্টের জিাপার খোলা।
ভদ্রলোক এমনভাবে মিসির আলির দিকে তাকালেন যেন মিসির আলি নিজেই জিপার খুলেছেন। মিসির আলি বললেন, উনি আছেন তো?
হ্যাঁ, আছেন। কিছুক্ষণ ওয়েট করুন। ভিড় কমুক, তারপর আপনাকে আন্টির কাছে নিয়ে যাব। জাষ্ট দেখা দিয়ে চলে যাবেন। বেশিক্ষণ বিরক্ত করবেন না? কথা বলা পুরোপুরি নিষেধ। আন্টির আবার বেশি কথা বলার অভ্যাস। কথা বলে বলে রোগ বাড়াচ্ছেন।
বোঝা যাচ্ছে ভদ্রমহিলা অসুস্থ। সম্ভবত হাসপাতালে ছিলেন। সম্প্রতি বাসায় আনা হয়েছে। অনেকেই তাকে দেখতে আসছে বলেই মিসির আলিকে এ বাড়ির সবাই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে।