স্যারকে মারছিল সর্দার চাচা। আমি একটা খাটের উপর দাঁড়িয়ে সেই ভয়ংকর দৃশ্য থরথর করে কাপতে কাঁপিতে দেখছি। স্যার একসময় রক্তবমি করতে লাগলেন এবং একসময় কাতর গলায় বললেন, আমারে জানে মারবেন না। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে।
সর্দার চাচা হিসহিস করে বললেন,-চুপ। শব্দ করলে কইলজা টান দিয়া বাইর কইরা ফেলামু। চুপ।
এরপর কী হল আমার মনে নেই। কারণ, আমার জ্ঞান ছিল না। আমি অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে যাই। জ্ঞান হলে দেখি আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। সর্দার চাচা আমার মাথায় পানি ঢালছেন।
আমি বললাম, উনি কি মারা গেছেন?
সর্দার চাচা বললেন, আরে দূর বোকা! মানুষ অত সহজে মরে না। মানুষ মারা বড়ই কঠিন। তারে রিকশায় তুল্যা বাসায় পাঠায়ে দিছি।
রক্তবমি করছিল?
পেটে আলসার থাকলে অল্প মাইর দিলেই নাকে-মুখে রক্ত ছোটে। ও কিছু না।
উনি তা হলে মরেন নাই?
না না। আইচ্ছা ঠিক আছে-তোমারে একদিন তার বাসায় নিয়া যাব নে!
আমি উনার বাসায় যাব না।
এইটাই ভালো। কী দরকার?
সর্দার চাচা আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। স্যারকে ঐরাতে ভয়ংকরীভাবে মারা হয়েছিল। অচেতন অবস্থায় তাঁকে গভীর রাতে বাহাদুর শাহ পার্কে ফেলে আসা হয়। সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যু হয় হাসপাতালে। মৃত্যুর আগে তাঁর জ্ঞান ফেরে নি। কাজেই তিনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু বলে যেতে পারেন নি। মুশফেকুর রহমান চুপ করল। হাই তুলতে তুলতে বলল, আজ এই পর্যন্ত থাক। ঠাণ্ডা বেশি লাগছে। মিসির আলি বললেন, আপনার স্যারের নাম কী?
উনার নাম জানি না। খুব অল্পদিন পড়িয়েছিলেন। নাম জানা হয় নি। উনি ছিলেন একজন পেশাদার প্রাইভেট টিউটর। ছাত্র পড়ানো ছাড়া আর কিছু করতেন না।
উনি আপনাকে কতদিন পড়িয়েছিলেন?
সপ্তাহ দুই। কিংবা তার চেয়েও কম। আমার শৈশবের ঘটনা আপনার কাছে কেমন লাগল?
মোটামুটি লেগেছে। সাজানো গল্প। যত সুন্দরই হোক সাজানো গল্প ভালো লাগে না।
মুশফেকুর রহমান তীক্ষ্ণ গলায় বলল, সাজানো বলছেন কেন?
গল্পটা সাজানো মনে করার পেছনে আমার অনেকগুলো কারণ মনে আসছে। যে ভদ্রলোক মাত্র দু সপ্তাহ আপনাকে পড়িয়েছেন তিনি এই সময়ের ভেতর আপনাকে গোপনে নিয়ে আপনার মার সঙ্গে দেখা করিয়ে আনার মতো দুঃসাহসিক পরিকল্পনা হাতে নেবেন তা বিশ্বাস্য নয়। আমার মনে হয়, ঘটনাটা এরকম-আপনি বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলেন। যখন আপনার সর্দার চাচা আপনাকে ধরুল তখন শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্যে মাস্টার সাহেবকে জড়িয়ে গল্পটা তৈরি করলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় হয়তো মাস্টার সাহেব সামনে পড়ে গেছেন। যে কারণে আপনাকে আপনার বাবা কোনো শাস্তি দেন নি। আপনার সর্দার চাচা ঐ নিরীহ মানুষটিকে এমন ভয়ংকর শাস্তি কোন দিল তাও পরিষ্কার হচ্ছে না। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত একটি শিশুঁকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। আর অপরাধ ধরা হলেও মৃত্যুদণ্ড তার শাস্তি হতে পারে না।
মুশফেকুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমার গল্প আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না?
না। কারণ গল্পে ফাঁক আছে।
সুদূর শৈশবের গল্প বলছি। ফাঁক থাকাই তো স্বাভাবিক।
ফাঁকগুলো অনেক বড়।
মুশফেকুর রহমান বলল, স্যার, শুরুতেই আপনি আমাকে একজন ভয়ংকর মানুষ ধরে নিয়েছেন। আমার কারণেই তা করেছেন। আমি নিজেকে ভয়ংকর মানুষ হিসেবেই আপনার সামনে উপস্থিত করেছি। যে কারণে অতি সামান্য অসামঞ্জস্যও আপনার কাছে অনেক বড় লাগছে। গল্পে ফাঁক আছে বলে যে দাবি আপনি করছেন, আমি সেই ফাঁক ঠিক ধরতে পারছি না। আমি শুধু বলছি যে,–যা ঘটেছে তা আপনাকে আমি বলার চেষ্টা করেছি। স্যার, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন। আপনাকে মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন আমার নেই।
মিসির আলি বললেন, আমাকে সত্য বলারও তো প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন আছে। সব ঘটনা আপনাকে ঠিকঠাকমতো জানানো দরকার।
আপনি ঠিকঠাকমতো বলছেন না। কী করে আপনি জানলেন যে মাস্টার সাহেবকে মেরে বাহাদুর শাহ পার্কে ফেলে আসা হয়? যদি ফেলেও আসে আপনাকে কেউ সেই তথ্য দেবে না। ক্লাস ফোরে যে ছেলেটি উঠেছে সে পরদিন খবরের কাগজ পড়ে এই তথ্য উদ্ধার করবে তা বিশ্বাস্য নয়। মাস্টার যে মারা গেছে। এটিও আপনার জানার কথা না। আপনার সর্দার চাচা কি আপনার কাছে স্বীকার করেছিলেন?
না স্বীকার করেন নি। তবে পরদিন খুব ভীত ভঙ্গিতে আমাকে বলেছিলেন-বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে। পুলিশ এলে আমি যেন বলি-আমি এই মাস্টারকে চিনি না।
পুলিশ কি এসেছিল?
জি এসেছিল, তবে আমার সঙ্গে পুলিশের কোনো কথা হয় নি। বাবার সঙ্গে কথা বলে তারা খুব খুশি মনে চলে যায়।
মাস্টার সাহেব যে বাহাদুর শাহ পার্কে পড়েছিলেন এই তথ্য কোথায় পেলেন?
মুশফেকুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হল কথাটা বলবেন কি বলবেন না তা ঠিক করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত বলে ফেললেন–
এই তথ্য আমি মাস্টার সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছি।
তার মানে?
যে মাস্টার সাহেবের কথা আপনাকে বললাম, উনি তাঁর মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে বাস করছেন।
কী বললেন?
ঐ মৃত ব্যক্তি গত একুশ বছর ধরে আমার সঙ্গে আছেন। তিনি আমাদের বাড়িতে বাস করেন। আমি জানি ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য। হাস্যকর। এটা যে বিংশ শতাব্দী তাও আমি জানি। মানুষ চাঁদে নেমেছে, চাঁদের মাটিতে মানুষের পায়ের ছাপ আছে। এটি যেমন সত্যি–আমার স্যার আমাদের বাড়িতে বাস করছেন এটিও তেমনি সত্য। আমি চাই আমার ঐ স্যারের সঙ্গে আপনার দেখা হোক, কথা হোক। তিনি আপনার মতোই বুদ্ধিমান। কিংবা কে জানে আপনার চেয়েও হয়তো বুদ্ধিমান। তাঁকে আপনার পছন্দ হবে।