ধরুন, আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। অন্য একটা রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লাগল। আমার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। তিনি চলন্ত রিকশায় উঠে দাঁড়িয়ে বলতেন-এক টান দিয়া ফাইলজা ছিঁড়্যা ফেলামু।
সর্দার চাচাকে আমি খুবই পছন্দ করতাম। কিন্তু উনি আমাকে পছন্দ করতেন কি করতেন না কোনোদিন জানতে পারি নি। সর্দার চাচাকে আমার অপছন্দ করার কোনো কারণ ছিল না। পছন্দ করতাম, কারণ আমার আর কেউ ছিল না। বাবার সঙ্গে আমার কোনো রকম যোগাযোগ নেই! মার সঙ্গেও নেই। বাবা মাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। মার এই বাড়িতে আসা নিষেধ ছিল।
আমাকে লালনপালন, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, স্কুল থেকে আনা সবই সর্দার চাচা করতেন। আমার জগৎ ছিল স্কুল এবং স্কুলের চার দেয়ালঘেরা আমাদের বাড়ি। স্কুল আমার ভালো লাগত না। বাড়িও ভালো লাগত না। আমি যখন ক্লাস ফোরো পড়ি তখন স্কুলে যাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেল। কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। শুধু শুনলাম-বাবা ঘলে দিয়েছেন, স্কুলে যেতে হবে না। মাস্টার এসে আমাকে বাড়িতে পড়াবে। আমার তুলে যেতে না দেওয়ার কারণ আমি তখন যা অনুমান করেছি তা হচ্ছে-কোনো একদিন হয়তো স্কুল থেকে আমার মা আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
মিসির আলি বললেন, এখন আপনার অনুমান কী?
আমি স্যার আমার অনুমানের কথা আপনাকে বলব না। আমি আমার অনুমানের কথা বলে আপনাকে প্রভাবিত করব না।
বেশ, আপনি বলতে থাকুন।
আমার জীবন কাটতে লাগল বাড়ির পেছনে কুয়োতলায়। বাঁধানো কুয়োতলা আমি চক দিয়ে ছবি এঁকে ভরিয়ে ফেলতাম। সন্ধ্যাকেলা সর্দার চাচা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলতেন–ভালো হইছে। সৌন্দৰ্য হইছে। তারপর কুয়ো থেকে বালতি বালতি পানি তুলে কুয়োতলা ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখতেন, যাতে পরদিন আমি ছবি আঁকতে পারি।
যে মাস্টার সাহেব আমাকে পড়াতে এলেন তাকে আমার পছন্দ হল। খুবই পছন্দ হল। হাসিখুশি। পড়াতেন খুব ভালো। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতেন।
মানুষটা খুব রোগা। অনেকখানি লম্বা। অতিরিক্ত লম্বার কারণেই বোধহয় কুঁজো হয়ে থাকতেন। চাইনিজদের মতো তার থুতনিতে দাড়ি ছিল। প্রচুর সিগারেট খেতেন। সস্তা দামের সিগারেট। সিগারেটের কড়া গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে যেত। বমি আসত। যখন গল্প শুরু করতেন তখন আর কিছু মনে থাকত না। তামাকের গন্ধও পেতাম না।
কী গল্প করতেন?
নানান ধরনের গল্প। চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের পুরো গল্পটা তিনি আমাকে বলেন, কাঁদতে কাঁদতে আমি এই গল্প শুনি। আজ পর্যন্ত আমি কাউকে এত সুন্দর গল্প বলতে শুনি নি।
অল্প কিছুদিন স্যার আমাকে পড়ালেন। তারপর তার চাকরি চলে গেল।
কেন?
আপনাকে পরে বলব। ব্যাখ্যা করে বলব। স্যারের প্রসঙ্গ এখন থাক। যে কথা বলছিলাম–উনার চাকরি চলে গেলেও উনি কিন্তু প্রায়ই আসতেন। চুপিচুপি আসতেন, বেছে বেছে এমন সময় আসতেন যখন বাবা থাকতেন না। গলা নিচু করে বলতেন, তোমাকে দেখতে আসলাম। ভালো আছ? তোমার বাবা বাসায় নাই তো? আমি যদি বলতাম, না। তিনি অসম্ভব আনন্দিত হয়ে তৎক্ষণাৎ সিগারেট ধরাতেন।
একদিন ঠিক দুপুর বেলায় এসে গলা নিচু করে বললেন, তন্ময়, বাবা একটা কথা শোন–তোমার মা তোমাকে একটু দেখতে চায়। শুধু একপলক দেখবে। তোমার মার খুব শরীর খারাপ। হয়তো বাঁচিবে না। তোমাকে খুব দেখার ইচ্ছা! তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? দুপুর বেলা তো তোমার বাবা বাসায় বেশিক্ষণ থাকেন না। তখন নিয়ে যাব। দেখা করিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। যাবে? এই দেখ, তোমার মা একটা চিঠিও দিয়ে দিয়েছেন। চিঠিটা পড়।
আমি চিঠিটা না পড়েই তৎক্ষণাৎ বললাম, হ্যাঁ।
তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, কাউকে কিছু বলবে না। কাউকে কিছু বললে তোমাকে নিতে দেবে না।
আমি কাউকে কিছু বলব না।
আমি তোমাকে নিতে আসব না-বুঝলে? তুমি করবে কি-দুপুর বেলায় সুযোগ বুঝে গেট দিয়ে বাইরে চলে আসবে। এক দৌড়ে সদর রাস্তায় চলে আসবে। একটা বেবিট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে না-ঐখানে আমি থাকব। তুমি আসামাত্র তোমাকে নিয়ে চলে যাব। আসতে পারবে না?
পারব।
দেখো, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। জানতে পারলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। তোমার বাবা আমাকে ক্ষমা করবেন না। উনি সেই মানুষই না। আমি একজন দরিদ্র মানুষ…
আমি যাব।
কবে আসবে?
আপনি বলুন।
আগামীকাল পারবো?
হুঁ। পারব।
উনাকে খুব চিন্তিত মনে হলেও আমি মোটেই চিন্তিত হলাম না। আমার মনে হলকেউ কিছু বুঝতে পারার আগেই আমি চলে আসব। তা ছাড়া শীতের দুপুরে সর্দার চাচা পাকা বারান্দায় পাটি পেতে রোদে ঘুমায়। বাবা বাসায় থাকেন না। তিনি ফেরেন। সন্ধ্যায়। গেটে যে থাকে সেও ঝিমুতে থাকে। এক ফাঁকে ঘর থেকে চলে গেলেই হল!
তাই করলাম। সবাইকে ফাকি দিয়ে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি বেবিট্যাক্সি স্ট্র্যান্ডের কাছে মাস্টার সাহেব শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে সিগারেট। তাঁকে দেখে দারুণ চিন্তিত মনে হল। ভীত চোখে চারদিকে তাকাচ্ছেন। আমাকে দেখে তার উৎকণ্ঠা আরো বাড়ল। তিনি বললেন, কেউ দেখে নি তো?
আমি বললাম, না।
তিনি বললেন, চল একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে নি।
উনি যখন বেবিট্যাক্সি দরদাম করছেন তখনই সর্দার চাচা উপস্থিত হলেন। আমাদের দুজনকেই বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাবা আসলেন সন্ধ্যাবেলা। তিনি আমাকে কিছুই বললেন না, কিন্তু স্যারের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। সেই শাস্তি ভয়াবহ শাস্তি। একতলার দারোয়ানের ঘরে দরজা বন্ধ করে মার! সেই ঘরের ভেতর আমিও আছি। বাবা চাচ্ছিলেন যেন শাস্তির ব্যাপারটা আমিও দেখি।