প্রকৃতি মানুষের জিনে অনেক তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারে না, কিংবা চায় না। তার যা বলার তা সে বলে দিয়েছে, লিখিতভাবেই বলেছে। সেই লেখা আছে জিনে-ডিএনএ এবং আরএনএ অণুতে। মানুষ সেই লেখার রহস্যময়তা জানে কিন্তু লেখাটা পড়তে পারছে না। একদিন অবশ্যই পারবে।
ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মিসির আলির উঠতে ইচ্ছা করছে না। তিনি অপেক্ষা করছেন। মুশফেকুর রহমান নামের লোকটির জন্যে। যদিও তিনি জানেন সে আজ আসবে না। কারণ মুশফেকুর রহমান জানে, মিসির আলি গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। রহস্যপ্রিয় মানুষ, নিজের রহস্য কখনো ভাঙবে না। আরো রহস্য তৈরি করবে। এই লোকটি তখনই তার কাছে আসবে–যখন মিসির আলি তার জন্যে অপেক্ষা করা বন্ধ করে দেবেন।
লোকটিকে খুঁজে বের করা কি কঠিন? মিসির আলির কাছে এই মুহুর্তে কাজটা কঠিন বলে মনে হচ্ছে না। বিত্তবান লোক হলে তার একটা টেলিফোন থাকার কথা। গাড়ি থাকার কথা। গাড়ি রেজিস্ট্রেশন কী নামে হয়েছে তা বের করা কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। গাড়ি না থাকলেও তার টিভি কিংবা রেডিও আছে। এদের জন্যেও লাইসেন্স করতে হয়। ঠিকানা আছে এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। বের করা যায় না। শুধু ঠিকানাহীন মানুষদের।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম।
স্যার, আমি মুশফেকুর রহমান। আপনি আজ পার্কে আসবেন ভাবি নি। আমি ভেবেছিলাম আজ আপনি পাখিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।
মিসির আলি স্বাভাবিক গলায় বললেন, পাখি দুটা ধরা পড়ে নি।
ধরা না পড়ারই কথা। খাঁচায় কাচা পেইন্টের গন্ধ। এই গন্ধ পাখি সহ্য করতে পারে না। আপনি কয়েকদিন খাঁচাটাকে বাইরে ফেলে রাখুন। রঙের গন্ধ দূর হোক।
মুশফেকুর রহমান মিসির আলির পাশে বসল। মিসির আলি তাকালেন। কিন্তু কিছু দেখতে পেলেন না। জায়গাটা ঘন অন্ধকার। মিসির আলি বললেন, আমি আপনার কথা শোনার জন্যে মানসিকভাবে তৈরি হয়ে এসেছি। শুরু করুন।
গল্প শোনার সময় আপনি কি আমার মুখ দেখতে চান না? অনেকে আবার মুখের দিকে না তাকিয়ে গল্প শুনতে পারে না, আবার বলতেও পারে না।
আপনি কি বলতে পারেন?
তা পারি। আমি আমার গল্প অন্ধকারেই বলতে চাই। আমার গল্প অন্ধকারের গল্প। কিন্তু স্যার, আপনার কি ঠাণ্ডা লাগছে না?
লাগছে।
আমি একটা চাদর নিয়ে এসেছি। চাদর গাড়িতে রাখা আছে। আমার চাদর ব্যবহার করতে আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
না, আপত্তি নেই।
মুশফেকুর রহমান বেঞ্চ ছেড়ে উঠে গেল। মিসির আলি লক্ষ করলেন সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তার গায়ে চান্দর। গায়ে চাদর থাকতেও সে আরেকটি চাদর নিয়ে এল কী জন্যে? তার জন্যে কি এনেছে? সে কি নিশ্চিত ছিল, মিসির আলি এসে বসে থাকবেন? গল্প শুনতে চাইবেন, এবং সে গল্প শুনাবে শীতের রাতে?
তাই যদি হয় তা হলে সে শুধু চাদর আনে নি, ফ্লাস্কে করে চা এনেছে। কিছু খাবার এনেছে। মিসির আলি ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট খান। সেই সিগারেটও এক প্যাকেট এনেছে। চাদর যদি তার জন্যে আনা হয় তা হলে চাদরটি হবে অব্যবহৃত, নতুন।
মুশফেকুর রহমান ফিরে এল। তার সঙ্গে ফ্লাস্ক। একটা প্যাকেটে পূর্বাণী কনফেকশনারির কিছু স্যান্ডউইচ। সে বসতে বসতে বলল, চাদরটা আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গায়ে দিন। এটি যদিও অনেক আগে কেনা, কখনো ব্যবহার করা হয় নি। দু’বছর আগে জয়পুর গিয়েছিলাম, তখন কেনা। রাত বলেই দেখতে পাচ্ছেন না, চাদরের গায়ে রেশমি সুতার কাজ করা আছে। এরা বলে জয়পুরী কাজ। চাদরটা আপনার জন্যে আমার সামান্য উপহার।
থ্যাংক ইউ। আমার ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট কোথায়?
মুশফেকুর রহমান হাসল। হাসতে হাসতে বলল, সিগারেটও এনেছি। দেব?
দিন এবং গল্প শুরু করুন।
কোত্থেকে শুরু করব? প্রথম খুন কীভাবে করলাম। সেখান থেকে?
না, নিজের কথা বলুন। আপনার ছেলেবেলার কথা।
মুশফেকুর রহমান ফ্লাস্কে চা ঢালতে ঢালতে গল্প শুরু করল–
আমার ছেলেবেলা মোটেই মজার নয়। গল্প করে বেড়াবার কিছু নেই। সব মনেও নেই–তবু বলছি।
আমি বড় হয়েছি পুরোনো ঢাকায়। অনেকের ধারণা নেই যে, পুরোনো ঢাকায় অসম্ভব বিত্তবান বেশকিছু মানুষ থাকেন। বাইরে থেকে তাঁদের অর্থ ও বিত্তের পরিমাণ বোঝা যায় না। আমাদের একেবারেই বোঝা যেত না। জেলখানার মতো উঁচু দেয়াল দেওয়া বাড়ি। গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকলে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। ফুলের বাগানটাগান নেই। এলোমেলোভাবে কয়েকটা বড় বড় দেশী ফুলের গাছ। চাপা গাছ, শিউলি গাছ, বাড়ির দক্ষিণ লিকে হাসনাহেনার প্রায় জঙ্গলের মতো ঝাড়। এই গাছগুলোতে কখনো ফুল ফোটে না। মাঝে মাঝে কেটে দেওয়া হয়। আবার আপনাতেই গজায়। বাড়ির পেছনে বেশকিছু ফলের গাছ। একটা আছে কামরাঙা গাছ। এই গাছে কিছু কামরাঙা হয়। অন্যগুলোতে ফল হয়। মা। একটা পাতকুয়া আছে। মেঝে বাঁধানো। কুয়ার পানি খুব পরিস্কার তবে বিশ্ৰী গন্ধ বলে সেই পানি ব্যবহার করা হয় না। বাড়িটা একতলা অনেক বড়। মূল বাড়ির উত্তরে কামরাঙা গাছের কাছে চার কামরার আলাদা একটা দোতলা বাড়ি। নিচে তিনি কামরা, উপরে এক কামরা। দোতলাটাকে আমরা বলতাম–উত্তর বাড়ি। দোতলার পুরোটাই বলতে গেলে ঘারান্দা! ছেলেবেলায় আমার উত্তর বাড়িতে যাওয়া পুরোপুরি নিষেধ ছিল। কারণ উত্তর বাড়িতে থাকতেন। বাবা। তিনি বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করতেন না। আমার বাবা পৃথিবীর বেশিরভাগ জিনিসই অপছন্দ করতেন। হইচই অপছন্দ করতেন, বাচ্চাকাচ্চা অপছন্দ করতেন, পান অপছন্দ করতেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল গাড়ি অপছন্দ করতেন। কারণ গাড়ি স্টার্ট করলে তটভষ্ট শব্দ হয়। যে কারণে আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না। আমি স্কুলে যেতাম গ্নিকশায়। আমাকে মাথা কামানো গ্যািট্রাগোট্রা একটা লোক স্কুলে নিয়ে যেত। তার নাম ছিল সর্দার। আমি ডাকতাম সর্দার চাচা। তিনি কথায় কথায় বলতেন—এক টান দিয়া কইলজা হিড়া বাইর কইরা ফেলামু। এমনভাবে বলতেন যেন তিনি কাজটা এক্ষুনি করবেন।