খাঁচার কী রকম দাম?
আপনি যদি বেয়াদবি না নেন-আমি আপনার জন্যে বড় একটা খাঁচা কিনেছি। আপনার বাসায় যে কাজের ছেলেটি আছে তাকে দিয়ে এসেছি।
কেন করলেন?
আপনার ভেতর কৌতুহল জাগানের জন্যে করেছি। আমি বেশ কিছুদিন ধরে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। আপনি কোনোরকম আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এমনকি আমার নাম পর্যন্ত জানতে চাচ্ছেন না। আমার ধারণা হয়েছে খাচাটা পেলে হয়তোবা আপনি কৌতুহলী হবেন। আমার নাম জানতে চাইবেন।
আপনার নাম কী?
আমার ডাকনাম তন্ময়। ভালো নাম মুশফেকুর রহমান।
আপনি আমার কাছে কী চান?
আমি আপনাকে একটা গল্প বলতে চাই।
প্রেমের গল্প?
প্রেমের গল্প বলা যেতে পারে।
মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয়–আমি প্রেমের গল্প শোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী?
হ্যাঁ, মনে হয়। আমার মনে হয় গল্প শুরু করলে আপনি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতে শুরু করবেন। আমার দরকার অসম্ভব মনোযোগী একজন শ্রোতা। যে গল্প শুনে যাবে। একটি প্রশ্নও করবে না। গল্প শুনে হাসবে না, ব্যথিত হবে না।
এমন শ্রোতা তো প্রচুর আছে। এই পার্কেই আছে।
আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি। আপনি বলতে চাচ্ছেন- এই পার্কে প্রচুর গাছ আছে। গাছগুলো আমার গল্পের মনোযোগী শ্রোতা হতে পারে। আপনি কি তাই বোঝাতে চাচ্ছেন না?
হ্যাঁ।
গাছকে আমি আমার গল্প শুনিয়েছি। গাছরা আমার গল্প মন দিয়ে শুনেছে এবং গল্পের মাঝখানে প্রশ্ন করে আমাকে বিরক্ত করে নি। কিন্তু ওরা আমার গল্প বুঝতে পেরেছে কি না তা আমি জানতে পারছি না।
আপনার গল্প বোঝা কি গাছদের জন্যে জরুরি?
গাছের জন্যে জরুরি নয়। আমার জন্যে জরুরি। খুবই জরুরি।
প্রেমের গল্পটি কি দীর্ঘ?
গল্প বেশ দীর্ঘ। তবে গল্পের মূল লাইনটি যাকে বটম। লাইন বলা হয় তা ছোট। স্যার, বটম লাইনটি বলব?
বলুন।
আমি আপনাদের মনোবিদ্যার ভাষায় একজন সাইকোপ্যাথ। আমি এ পর্যন্ত দুটি খুন করেছি। খুব ঠাণ্ডা মাথায় করেছি। খুব ভেবেচিন্তে করা। এই খুন দুটি করার জন্যে আমার মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। আমি তৃতীয় খুনটির প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছি। প্রস্তুতিপৰ্ব আপনাকে বলতে চাচ্ছি। প্ৰস্তৃতিপর্বে প্রেমের ব্যাপার আছে। এই জন্যেই বলছি প্রেমের গল্প।
দুটি খুন করেছেন। তৃতীয়টি করবেন। করে ফেলুন। আমাকে বলার দরকার কী? আমার অনুমতি নেওয়ার ব্যাপার তো নেই।
স্যার, আপনি কি আমার গল্প বিশ্বাস করেছেন?
হ্যাঁ করেছি।
আমি তো আপনাকে একটা ভয়াবহ কথা বললাম। আপনি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করলেন?
হ্যাঁ করলাম।
কেন করেছেন?
আমি মানুষকে কখনোই অবিশ্বাস করি না। তা ছাড়া একজন মানুষ অকারণে কেন আমাকে এসে বলবে। আমি দুটা খুন করেছি, তৃতীয়টি করব? এখন বলুন কেমন লাগে মানুষ খুন করতে?
ভালো লাগে। স্যার।
লোকটি হেসে ফেলল। সুন্দর হাসি। কিন্তু মিসির আলি শিউরে উঠলেন। লোকটির জিহ্বা কুচকুচে কালো। সে যখন হেসে উঠল মিসির আলি ব্যাপারটা তখনই লক্ষ্য করলেন।
লোকটি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি আপনার ভেতর কৌতুহল জাগ্রত করতে পেরেছি। কাজেই আমি জানি আপনি এখন আমার কথা শুনবেন। আর স্যার, আপনি আমার জিহ্বা দেখে যেভাবে চমকে উঠেছেন সেভাবে চমকে ওঠার কিছু নেই। খুব ছোটবেলায় আমার অসুখ হয়েছিল। কালাজ্বর। ব্ৰহ্মচারী ইনজেকশন নিতে হয়েছে। সেইসঙ্গে আয়ুৰ্বেদি এক ওষুধ খেয়ে জিহ্বা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। স্যার যাই!! খুব শিগগিরই আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে। ও ভালো কথা, স্যার এই বইটিও আমি আপনার জন্যে এনেছি। অষ্ট্রেলিয়ান পাখিদের ওপর একটা বই। পাখিদের সম্পর্কে কিছু তথ্য এই বইটিতে পেতে পারেন।
আপনার ভালো নাম কী যেন বললেন? মুশফেকুর রহমান?
জ্বি।
আপনার সঙ্গে আমার কোথায় দেখা হবে? আপনার ঠিকানা কী?
আমাকে আপনার খুঁজে বের করতে হবে না, স্যার। আমিই আপনাকে খুঁজে বের করব।
কাজের ছেলেটির নাম বদু
মিসির আলির কাজের ছেলেটির নাম বদু। বয়স পনের-ষোল। বামন ধাঁচ আছে, লম্বা হচ্ছে না। ছেলেটা বোকা ধরনের, তবে অত্যন্ত অনুগত। রাতে মিসির আলির বাড়ি ফিরতে দেরি হলে চিন্তিত মুখে সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুদিন পরপর এত কম বেতনে কাম করমুনা বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। মিসির আলি তাকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করছেন। গত তিন মাসে সে অ আ এবং ই পর্যন্ত শিখেছে। তাও ভালোমতো শিখতে পারে নি। অ এবং আ-তে গণ্ডগোল হচ্ছে। কোনটা অ, কোনটা আ, এখনো ধরতে পারে না। তার পরেও পড়ালেখার কাজটি সে খুব আগ্রহ নিয়ে করে।
মিসির আলি ঘরে ঢুকে দেখলেন বদু পড়ছে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে। বই প্লেট পেনসিল চারদিকে ছড়ানো। মিসির আলি বললেন, কেউ কি পাখির খাঁচা দিয়ে গেছে?
বদু বলল, হা। সুন্দরমতো একটা লোক আইছিল।
লোকটা কী বলল?
বলছে, বদু, খাঁচাটা রাখো! স্যার এলে তাঁর হাতে দিও। আর এই নাও একটা চিঠি।
বদু কথাগুলো হুবহু বলে গেল। মিসির আলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। বদু মুশফেকুর রহমানের কথাগুলো যন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছে। স্মৃতিশক্তির কোনো সমস্যা এখানে হচ্ছে মা অথচ সামান্য আী অ, তার মনে থাকছে না। এর কারণটা কী?
তোকে বলল, বদু! খাঁচাটা রাখো?
জে বলছে।
তোর নাম জানল কীভাবে?
তা ক্যামনে কব। হে তো আমারে বলে নাই।