আমি রানুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। সে মাটিতে পড়ে গেল।
সে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমাকে এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে। যেভাবে আছ সেইভাবে।
রানু কোনো প্রশ্ন করল না। উঠে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। ইসমাইল চাচা ঢুকলেন তার কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনি বললেন-কী ব্যাপার?
আমি কঠিন গলায় বললাম, চাচা। আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
আমি তার জবাব দিলাম না। রানু মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে গেল। তার এক ঘণ্টার ভেতরই বাবা মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন।
অনেক অনেক দিন পর আমি আবার একা হয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর থেকে ঘন হয়ে বৃষ্টি নামল। রীতিমতো ঝড় শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমি অন্ধকার বারান্দায় বসে রইলাম। আমার দৃষ্টি দোতলার বারান্দার দিকে। জায়গাটা গাঢ় অন্ধকারে ড়ুবে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে–সেই আলোয় আমি উলঙ্গ মাস্টার সাহেবকে রেলিঙে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বাতাসের এক একটা ঝাপটা আসছে। সেই ঝাপটায় ভেসে আসছে সিগারেটের কড়া গন্ধ। আবারো সেই গন্ধ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হাসনাহেনার গন্ধে। সেবার আমাদের হাসনাহেনা গাছে প্রথমবারের মতো ফুল ফুটেছিল। মানুষের সঙ্গে গাছের হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে। নয়তো কখনো যে গাছে ফুল ফোটে না-হঠাৎ সেখানে কেন ফুল ফুটল?
রাত বাড়তে লাগল। বৃষ্টি বাড়তে লাগল। কামরাঙা গাছের ডাল বাতাসে নড়তে লাগল। আমি এগিয়ে গেলাম দোতলার দিকে। সিঁড়ির মুখ কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ। মাস্টার সাহেব বললেন, কাঁটাতারের বেড়া খুলে রেখেছি, তুমি উঠে এস।
আমি উঠে গেলাম। কঠিন গলায় বললাম, আপনি কী চান?
তিনি বললেন, আমি কিছু চাই না তন্ময়। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
আপনার সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই।
তুমি তো ভুল কথা বলছি তন্ময়। এখনই আমার সাহায্যের তোমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সাহায্য করব। আমি আমার কথা রাখি।
আপনি কেউ না। আপনি আমার অসুস্থ মনের কল্পনা।
কে বলল তোমাকে?
আমি মনোবিদ্যার ছাত্র। আমি জানি। আমি সিজোফ্রেনিয়ার রুগি। সিজোফ্ৰেনিয়ার রুগিদের হেলুসিনেশন হয়। তারা চোখের সামনে অনেক কিছু দেখতে পায়। আমি তাই দেখছি।
তোমাদের ইসমাইল সাহেব কি সিজোফ্রেনিয়ার রুগি?
না।
তিনি কিছু আমাকে দেখেছেন। কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছেন। এ ঘরে তোমাদের আসতে নিষেধ করেছেন। নিষেধ করেন নি?
হ্যাঁ করেছেন।
তোমার বান্ধবী। রানু মেয়েটিও কিন্তু আমাকে দেখেছে। ঘটনাটা তোমাকে বলি। এক দুপুর বেলায় সে হাঁটতে হাঁটতে আমার ঘরের দিকে চলে এল। তাকাল বারান্দার দিকে। আমি তখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। নগ্ন অবস্থায় দাঁড়ালাম বলাই বাহুল্য। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে গেল। আমি তখন তাকে কুৎসিত একটা কথা বললাম… বললাম…
চুপ করুন।
রেগে যাচ্ছ কেন? রেগে যাবার কী আছে-তোমার কথা যদি ঠিক হয় তা হলে আমার অস্তিত্ব নেই। আমি তোমার মনের কল্পনা। কাজেই আমি মেয়েটিকে কী বলেছি তা শুনতে তোমার আপত্তি হবে কেন? আমি মেয়েটিকে,.…
Stop.
হা হা হা। মেয়েটি এতই ভয় পেয়েছিল যে নড়তে-চড়তে পারছিল না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এই ফাঁকে আমি কিছুকুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করলাম। কে জানে এগুলো হয়তো তার পছন্দ হয়েছে।
আমি আপনার পায়ে পড়ছি থামুন।
বেশ থামলাম। রানু তোমাকে এই ঘটনার কিছু বলে নি?
না!
আমার কথায় তোমার যদি সন্দেহ থাকে তুমি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।
জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি না। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করলাম।
ভেরি গুড। এখন মনোবিজ্ঞানীর ছাত্র। তুমি আমাকে বল, তোমার ইসমাইল চাচা কিংবা তোমার বান্ধবী ওরা সিজোফ্রেনিয়ার রুগি না হয়েও আমাকে দেখছে কী করে? এর ব্যাখ্যা কী?
আমি এর ব্যাখ্যা জানি না।
শুধু তুমি কেন। কেউই জানি না। এই পৃথিবীতে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমন জিনিসের সংখ্যাই বেশি।
আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না। কিন্তু একজন পারবেন।
তাই নাকি! সেই একজনটা কে?
তিনি আমার স্যার। তাঁর নাম মিসির আলি।
নিয়ে এস তোমার স্যারকে।
তাঁকে আনার আমি কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমার সমস্যা আমিই সমাধান করব।
এবং যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।
হ্যাঁ।
ভালো খুব ভালো। আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি।
আপনাকে একটা কথা দিতে হবে। আপনি রানুর কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না।
তুমি অদ্ভুত কথা বলছ তন্ময়। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না। আবার তুমি বলছি–আমি রানুর কোনো ক্ষতি করতে পারব না। এরকম করছ কেন?
এরকম করছি কারণ মানুষ একই সঙ্গে বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাস করে না।
কে বলেছে, তোমার স্যার?
হ্যাঁ।
ইন্টারেস্টিং মানুষ। তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। উনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবেন আমার অস্তিত্ব নেই। আমি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করব উনার অস্তিত্ব নেই। হা হা হয়। কবে তুমি তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে?
আনব। তাঁকে আমি আনব। আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি রানুর কোনো ক্ষতি করবেন না।
দেখ তন্ময় আমি তোমার স্বাৰ্থ দেখব। তোমার ভালো দেখব। যদি আমার কখনো মনে হয়। এই মেয়ের কারণে তোমার ক্ষতি হচ্ছে তখনই আমি তাকে সরিয়ে দেব। এখন আমার অনেক ক্ষমতা। তবে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত যখন নেব, তোমাকে জানিয়েই নেব।