রানু বিস্মিত হয়ে বলল, কেন বাবা?
তিনি কঠিন গলায় বললেন-আমি নিষেধ করেছি। এই জন্যে। তিনি কাঠের মিস্ত্রি ডাকিয়ে দোতলা ঘরের দুটি দরজাতেই আড়াআড়ি পাল্লা লাগিয়ে দিলেন। দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে কাঁটাতারের গেট করে দিলেন। আমার জীবনের একটি অন্ধকার অংশকে তিনি পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। পুরোপুরি বোধহয় পারলেন না। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো খাট থেকে নেমে আসি।
খাটের নিচে টর্চের আলো ফেলি। না কেউ সেখানে নেই। তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে আবার ঘুমুতে যাই।
আমি মেট্রিক পাস করলাম।
খুব ভালোভাবে পাস করলাম। পত্রিকায় আমার নাম ছাপা হল। আইএসসি পরীক্ষায় আরো ভালো ফল করলাম। এবার পত্রিকায় ছবি ছাপা হল। আমার কৌতূহল ছিল মনোবিজ্ঞানে, সায়েন্স ছেড়ে আর্টস নিলাম। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রানুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সহজ। এই সম্পর্কে কোনো রকম জটিলতা ছিল না। মেয়েদের সঙ্গে মেশার আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। কারো সঙ্গেই আমি কখনো মিশি নি। কাছ থেকে দেখিও নি। এই প্রথম একজনকে দেখলাম। অন্য মেয়েরা কেমন জানি না–এই মেয়েটিকেই জানি। সহজ একটা মেয়ে কিন্তু রহস্যময়।
আমি রাত জেগে পড়ি সে রাত জগতে পারে না। ঘুম ঘুম চোখে পাশে বসে থাকে। আমি বলি তুমি ঘুমিয়ে পড়। তুমি জেগে আছ কেন?
সে বিস্মিত হয়ে বলে, তাই তো আমি কেন জেগে আছি। আমি ঘুমাতে গেলাম।
তুমি কতক্ষণ পড়বে?
অনেকক্ষণ।
রাত একটা, না রাত দুটা?
দুটা।
আজ একটা, পর্যন্ত পড়লে কেমন হয়?
একটা পর্যন্ত পড়লে তোমার কী লাভ?
তুমি রাত জেগে পড়। আমার দেখতে কষ্ট হয়।
কষ্ট হয় কেন?
জানি না কেন হয়। তবে হয়।
আমি রানুর ভেতর অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করতে লাগলাম। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকার প্রবণতা। যতক্ষণ বাড়িতে থাকব ততক্ষণই সে আমার পাশে থাকবে।
বাড়ির রান্নাবান্না তাকে করতে হয়। রান্না করতে যাবে, কিছুক্ষণ পরপর উঠে আসবে। আমি যদি বলি-কী? সে তৎক্ষণাৎ বলবে, কিছু না।
মাঝে মাঝে সে ভয়াবহ অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যায়। দেখেই মনে হয় তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে ঝড়ের কারণ সে জানে না। আমিও জানি না।
ইসমাইল চাচা তার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে চলে যাওয়া ঠিক করলেন। রানু বলল, অসম্ভব, আমি যাব না। ও বেচারা একা থাকবে? এত বড় বাড়িতে একা থাকলে ভয় পাবে না? এমনিতেই সে ঘুমের মধ্যে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে কাঁদে। যদি যেতে হয় তাকে নিয়ে যেতে হবে। বাবার সঙ্গে সে চাপা গলায় ঝগড়া করে এবং একসময় আমাকে এসে বলে, তুমি কি চাও আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?
আমি বলি, না না। কখনো চাই না।
তুমি চাইলেও আমি যাব না। তুমি কখনো, কোনোভাবেই এ বাড়ি থেকে আমাকে তাড়াতে পারবে না।
কী আশ্চর্য! তাড়ানোর প্রশ্ন আসছে কেন?
আমি জানি না কেন আসছে। মাঝে মাঝে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কী করি না করি নিজেই বুঝি না। সরি। কী সব অদ্ভুত ব্যাপার যে আমার হচ্ছে। তুমি যখন রাত জেগে পড়, আমিও রাত জগতে চেষ্টা করি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বাধ্য হয়ে ঘুমুতে যাই। তখন আর ঘুম আসে না। রাতের পর রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটাই। তুমি কি সেটা জান?
না। এখন জানলাম।
আমার কী করা উচিত?
ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত।
ঘুমের ওষুধ আমার আছে। কিন্তু আমি খাই না। রাত জেগে আমি নানান কথা ভাবি। আমার ভালোই লাগে।
আমাদের দিনগুলো এই ভাবেই কাটছিল। তারপর একদিন একটা ঘটনা ঘটল। তখন আমি এম.এ. ক্লাসের ছাত্র। বর্ষাকাল। কদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে! ক্লাস থেকে ফিরেছি। বিকেলে। গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় দেখি, রানু এই বৃষ্টির মধ্যে বাগানে দাঁড়িয়ে ভিজছে। কী যে সুন্দর তাকে লাগছে! আমি চেঁচিয়ে বললাম-এই রানু এই!
রানু ছুটে এল। হাসতে হাসতে বলল, এই যে ভাই ভালো ছাত্ৰ-তুমি কি আমার সঙ্গে একটু বৃষ্টিতে ভিজবে? নাকি খারাপ ছাত্রীর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা নিষেধ?
আমি বললাম, না নিষেধ না-চল বৃষ্টিতে ভিজি।
অসুখে পড়লে আমাকে কিন্তু দোষ দিতে পারবে না।
না, দোষ দেব না। দাঁড়াও খাতাটা রেখে আসি।
রানু বলল, না না। খাতা রাখতে যেতে পারবে না। খাতা ছুড়ে ফেলে দাও।
আমি খাতা ছুড়ে ফেললাম। রানু চেঁচিয়ে বলল, স্যান্ডেল খুলে ফেল। আজ আমরা গায়ে কাঁদা মাখব। পানিতে গড়াগড়ি খাব। দেখো বাগানে পানি জমেছে।
আমি স্যান্ডেল ছুড়ে ফেললাম। রানু বলল-আজ বাসায় কেউ নেই। পুরো বাড়িতে শুধু আমরা দুজন।
রানু কথাগুলো কি অন্যভাবে বলল? কেমন যেন শোনাল। যেন সে প্রবল জুরের ঘোরে কথা বলছে। কী বলছে সে নিজেও জানে না।
আমি বললাম, তোমার কী হয়েছে রানু?
রানু থেমে থেমে বলল, আমার কী হয়েছে আমি জানি না। আমার খুব অস্থির অস্থির লাগছে। আমি আজ ভয়ংকর একটা অন্যায় করব। তুমি রাগ করতে পারবে না। আমাকে খারাপ মেয়ে ভাবতে পারবে না।
রানু ঘোর লাগা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে অদ্ভুক্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে খারাপ মেয়ে ভাব আর যাই ভাব-আমি এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা অন্যায় করব। প্লিজ চোখ বন্ধ করা। তুমি তাকিয়ে থাকলে অন্যায়টা আমি করতে পারব না।
চোখ বন্ধ করতে গিয়েও চোখ বন্ধ করতে পারলাম না। আমি বুঝতে পারছি রানু কী করতে যাচ্ছে। আমি কেন যে কোনো মানুষই তা বুঝবে। আমার নিজেরও যেন কেমন লাগছে। হঠাৎ দোতলার দিকে তাকালাম, আমার সমস্ত শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি দেখলাম আমার উলঙ্গ মাস্টার সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তিনি কী চান আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম। তিনি আমার সব প্রিয়জনদের একে একে সরিয়ে দিচ্ছেন-প্ৰথমে বাবা, তারপর সর্দার চাচা। এখন রানু। তা সম্ভব না। কিছুতেই সম্ভব না।