রাত এগারোটা হয়েছে। সব বাতি নিভে গেছে। আমি মশারির ভেতর শুয়ে আছি। আমার বালিশের কাছে দু ব্যাটারির একটা টর্চ লাইট। অন্য সময় বিছানায় যাওয়ামাত্র ঘুম এসে যায়। আজ ঘুম আসছে না। জেগে আছি। হঠাৎ পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল। বিচিত্র শব্দ হল। বাড়ি কেঁদে উঠল কিংবা হেসে উঠল। বুকের ভেতর ধক করে উঠল। আর তখন লক্ষ করলাম কুকুরগুলো একে একে আমার ঘরের দরজার ঘাইরে জড়ো হচ্ছে। এরা চাপা গর্জন করছে। দরজা আঁচড়াচ্ছে। এরা এরকম করছে কেন?
আমার মনে হল খাটের নিচে কী যেন নড়ে উঠল। কেউ যেন নিশ্বাস ফেলল। আমি টুর্ট লাইট জুলিয়ে খাট থেকে নেমে এলাম। বসলাম খাটের পাশে–টর্চ লাইট ধরলাম।
প্রথমে দেখলাম দুটা চকচকে চোখ। পশুদের চোখে হঠাৎ আলো ফেললে যেমন চকচক করতে থাকে। এই চোখ দুটিও ঠিক সেরকমই চকচক করছে। তারপর মানুষটাকে দেখলাম। নগ্ন একজন মানুষ। খাটের নিচে কুঁজো হয়ে বসে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। যেন টর্চ ফেলে তাকে দেখায় সে আনন্দিত।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, কে?
লোকটা জবাব দিল না। নিঃশব্দে হাসল। তখনই আমি তাকে চিনলাম। আমার প্রাইভেট স্যার।
তখনো আমার এই বোধ হয় নি যে আমি ভয়ংকর একটি দৃশ্য দেখছি। যাকে দেখছি সে মানুষটি জীবিত নয়-মৃত। একজন মৃত মানুষ খাটের নিচে কুঁজো হয়ে বসে থাকতে পারে না। আমি একটি ভয়াবহ অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখছি।
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে পড়লাম। যেন কিছুই হয় নি। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। টর্চের আলো নিভিয়ে দিলাম। আর তখনই সীমাহীন ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করল। এই ভয়ের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। এ ভয়ের জন্ম পৃথিবীতে নয়–অন্য কোথাও।
তীব্ৰ ভয়ের পরপরই একধরনের অবসাদ আছে। ভয়ংকর সত্যকে সহজভাবে নিতে ইচ্ছা করে। ফাঁসির আসামি মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর আতঙ্কে অস্থির হয়। সেই আতঙ্ক দ্রুত কমে যায়। মৃত্যুর ক্ষণ যখন উপস্থিত হয় তখন সে সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে যায়। ফাঁসির মঞ্চের দিকে। এমন কোনো ফাঁসির আসামির কথা জানা নেই–যাকে কোলে করে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে হয়েছে।
আমি মাস্টার সাহেবকে গ্ৰহণ করলাম সহজ সত্য হিসেবে। এ ছাড়া আমার উপায়ও ছিল না। মাস্টার সাহেব বাস করতে শুরু করলেন আমার খাটের নিচে। দিনের বেলা কখনো তাকে দেখা যায় না। সন্ধ্যাবেলা না। রাতে শোবার সময় খাটের নিচে তাকাই। তখনো কেউ নেই। শুধু গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলেই তীব্ৰ তামাকের গন্ধ পাই। বুঝতে পারি খাটের নিচে তিনি আছেন। কুকুরগুলো দরজা আঁচড়াতে থাকে। তিনি কিছু কিছু কথাও বলেন। এবং আশ্চর্যের কথা–আমি জবাব দেই। যেমন–
তুমি জেগেছ?
হুঁ।
কটা বাজে?
জানি না।
ভয় লাগছে?
না।
পড়াশোনা হচ্ছে ঠিকমতো?
হচ্ছে!
তোমার সর্দার চাচাকে আমার কথা বলেছ?
না।
কাউকেই বল নি?
না।
ইচ্ছে করলে বলতে পার। অসুবিধা নেই।
ইচ্ছে করে না।
আমি কেন তোমার খাটের নিচে থাকি জান?
না।
জানতে চাও না?
না।
জানতে না চাইলে জানতে হবে না। সবকিছু জানতে চাওয়া ভালো না। না জানার মধ্যেও আনন্দ আছে। আছে না?
জি আছে।
ইংরেজি একটা প্ৰবাদ আছে। তোমাকে একবার পড়িয়েছিলাম। মনে আছে?
আছে।
বল তো দেখি।
মনে পড়ছে না।
মনে করার চেষ্টা কর। ইংরেজি বেশি বেশি করে পড়বে। অর্থের মানে বুঝতে না পারলে ডিকশনারি দেখবে।
আচ্ছা।
তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়েছ-কাজেই আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। আমি তোমাকে সাহায্য করব। পরামর্শ দেব।
আচ্ছা।
আমার সম্বন্ধে তোমার কি কিছু জানতে ইচ্ছে করে?
না।
জানতে ইচ্ছে করলে জিজ্ঞেস কর। আমি বলব। আমি এমন সব বিষয় জানি যা জীবিত মানুষ জানে না।
আমি কিছু জানতে চাই না।
ঘুম পাচ্ছে?
হুঁ।
ঘুমিয়ে পড়। মশারি ঠিকমতো গোজা হয়েছে?
হুঁ।
বড্ড মশা। তুমি ঘুমাও। টর্চ লাইটটা কি হাতের কাছে আছে?
আছে।
একবার জ্বালিয়ে দেখে নাও ব্যাটারি ঠিক আছে কিনা।
ঠিক আছে।
তোমার সর্দার চাচাকে বলে আরেক জোড়া ব্যাটারি এনে রাখবে।
জি আচ্ছা।
ঘুমিয়ে পড়া।
জি আচ্ছা।
গায়ে চাদর দিয়েছ কেন? চাদর সরিয়ে ফেল। গরমে চাদর-গায়ে ঘুমুলে গায়ে ঘামাচি হবে।
আমি চাদর সরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি। আবার ঘুম ভাঙে। তীব্র তামাকের গন্ধ পাই! আমার ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারেন। ভরাট গলায় বলেন, ঘুম ভেঙেছে?
হুঁ।
অসহ্য গরম পড়েছে। ঘন ঘন ঘুম ভাঙারই কথা। পানির পিপাসা হয়েছে?
না।
বাথরুমে যাবে?
না।
গল্প শুনতে চাও?
না।
আমি তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তা করছি। এই সংসারে তুমি খুব শিগগিরই একা হয়ে যাবে। তোমার বাবা বেশিদিন বাঁচবেন না। সর্দার চাচাও থাকবেন না। তুমি হবে একা। বুঝতে পারছ?
পারছি।
তোমরা বাবা যে মারা যাবেন। এতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
হচ্ছে।
কষ্ট হওয়ারই কথা। তবে মৃত্যু তাঁর জন্যে মঙ্গলজনক হবে। কিছু মানুষের জন্যে মৃত্যু মঙ্গলময়। উনি অসুস্থ। অসুস্থতা ক্রমেই বাড়ছে। উনার যে অসুখ সেটা আরো বেড়ে গেলে–চারদিকে বিকট সব জিনিস দেখতে পান। সেই সব ভয়ংকর জিনিস দেখার কষ্ট মৃত্যু-যন্ত্রণার চেয়েও শতগুণে বেশি। মৃত্যু-যন্ত্রণা একবার হয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা হতেই থাকে। শেষ হয় না। ধাপে ধাপে বাড়ে। তোমার মনে হয় না। মৃত্যু তাঁর জন্যে ভালো?
জি মনে হয়।
করি। সাহায্য করা উচিত না?
জি উচিত।
কীভাবে সাহায্য করা যায় তুমি বল তো?