আপনি বললে পারব।
এই ভালো। নিজে নিজে পড়। আর তোর যদি পড়াশোনা না হয় তা হলেও ক্ষতি নেই। টাকা পয়সা আমি যা রেখে যাব দুহাতে খরচ করেও শেষ করতে পারবি না। আমার মৃত্যুর পর দুহাতে খরচ করবি। জায়গাজমি সব বিক্রি করে দিবি। তোর কোনো টাকা পয়সা জমিয়ে রাখার দরকার নাই। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
আচ্ছা যা। আমি সর্দারকে বলে দেব সে যেন মাস্টারকে আসতে নিষেধ করে।
আচ্ছা!
আরেকটা কথা–রাতে-বিরাতে দরজা খুলে বের হবি না। কুকুরগুলো ভয়ংকর–এরা তোকে খেয়ে ফেলবে।
কুকুরগুলো ছিল সত্যি ভয়ংকর। রাতে যতবার ঘুম ভাঙত, শুনতাম, এরা চাপা গর্জন করছে। একটা কুকুর রোজ রাতে আমার দরজা আঁচড়াত। রাতে একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুমুতে পারতাম না।
আমি কি এখন চলে যাব?
আচ্ছা যা।
বাবা বালিশ উঁচু করে বালিশের নিচ থেকে চকচকে একটা দশ টাকার নোট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–বাদাম কিনে খাস।
যতবার বাবার কাছে গিয়েছি ততবারই বাদাম কিনে খাবার জন্যে একটা করে চকচকে দশ টাকার নোট পেয়েছি। বাদাম অবিশ্যি খাওয়া হয় নি। আমাকে দোকানে নিয়ে যাওয়া নিষেধ ছিল। টাকাগুলো আমি একটা কোটায় জমা করে রেখেছি। যতবার টাকাগুলো দেখি ততবারই ভালো লাগে।
বাবার হুকুমে সর্দার চাচা মাস্টার সাহেবকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দেন। তারপরও তিনি মাঝে মধ্যে আসতেন। অনেকক্ষণ থাকতেন। এর মধ্যে একদিন এসে আমার হাতে একটি চিঠি দিলেন। সেই চিঠি আমার মোর লেখা। মা আমার সঙ্গে দুটা কথা বলতে চান। আমি কি তার কাছে যেতে পারব?
আমি মাস্টার সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে। পরদিন বাড়ি থেকে বের হলাম। ধরা পড়লাম সর্দার চাচার হাতে। বাকি ঘটনা। আপনি জানেন। ঐ অংশটি দ্বিতীয়বার বলতে চাই না। যে কথাটা আপনাকে আগে বলা হয় নি তা হচ্ছে -ঐ চিঠি আমার মার লেখা ছিল না। ঐ চিঠি মাস্টার সাহেবের লেখা।
মিসির আলি লক্ষ করলেন শেষ পাতাটি দুদিন আগে লেখা হয়েছে। এবং প্রচুর কাটাকুটি করা হয়েছে। যেন মুশফেকুর রহমান বুঝতে পারছে না-কী লিখবে। বাংলা ভাষাটাও মনে হচ্ছে ভাব প্রকাশের জন্যে সে উপযুক্ত মনে করছে না। কারণ শেষ পাতাটা ইংরেজিতে লেখা। শেষ পাতার বক্তব্য হল-আমি ভয় পাচ্ছি, বাবা সম্পর্কে আমি আমার মনের ভাব ঠিকমতো প্ৰকাশ করতে পারি নি। আমি তাকে অসম্ভব ভালবাসি।
তৃতীয় চ্যাপ্টার
মিসির আলি তৃতীয় চ্যাপ্টার-পড়ছেন। এই অংশটি নতুন লেখা হয়েছে। তারিখ দেখে মিসির আলি বুঝতে পারছেন—পার্কে তাঁর সঙ্গে দেখা হবার পর—এই লেখা শেষ করা হয়েছে। পুরা লেখাটা ইংরেজিতে লেখা। শিরোনাম—I and We. বাংলা করলে হয়তো হবে–আমি এবং আমরা।
আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয়েছে আমি ভীতু? একজন মানুষকে দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব না-সে। সাহসী না ভীতু। তা ছাড়া একজন ভীতু মানুষকেও ক্ষেত্রবিশেষে খুব সাহসী হতে দেখা যায়।
আমি ভীতু না। কখনোই ছিলাম না। বাবাকে ভয় করতাম, বাবার কুকুরগুলোকে ভয় করতাম। বাবা যে বদুক নিয়ে মাঝে মাঝে দোতলায় বের হতেন। সেই বদুকটাকে ভয় করতাম। আমার ভয় এই তিনটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ও না, আরেকটি ভয়ের ব্যাপার আমার মধ্যে ছিল। আমাদের পুরো বাড়ি মাঝে মধ্যে এক ধরনের বিচিত্র শব্দ করে নড়ে উঠত। সর্দার চাচা বলতেন, বাড়ি মাঝে মধ্যে কঁদে, হাসে। এতে ভয়ের কিছু নাই।
অন্ধকারকে ভয় পাওয়া আমার মধ্যে ছিল না। পুরোনো ঢাকায় প্রায়ই ইলেকট্রসিটি চলে যায়। হয়তো রাতে এক ঘরে বসে আছি–হঠাৎ পুরো অঞ্চলের কারেন্ট চলে গেল! গাঢ় অন্ধকারে আমি একা বসে আছি। নিজের হাতও দেখা যাচ্ছে না–এই অবস্থাতেও আমি কখনো ভয় পাই নি! –
ভূতপ্রেতে ভয় পাওয়ার ব্যাপারও আমার মধ্যে ছিল না। কারণ ভয়ের গল্প আমাকে কেউ শোনায় নি। কেউ আমাকে বলে নি ঘরের কোনায় বাস করে কোণী ভূত। খাটের নিচে উবু হয়ে বসে থাকে কন্দকাটা। গভীর রাতে সে তার সরু বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত খাটের নিচ থেকে বের করে শুয়ে থাকা মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করে। শিশুরা সচরাচর যেসব কারণে ভয়ে কাতর হয়ে থাকে। সেসব আমার ছিল না। তা ছাড়া অল্পবয়সেই যুক্তি ব্যবহার করতে শিখি। ভয়কে পরাজিত করতে যুক্তির মতো বড় অস্ত্ৰ আর কী হতে পারে? ধরুন-গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল।
আমি শুনলাম, বাথরুমে খটখটি শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন হীটছে। আতঙ্কে অস্থির না। হয়ে আমি যুক্তি দাঁড় করলাম নিশ্চয় নিশ্চয়ই ইঁদুর। কিছুক্ষণ কান পেতে রইলাম। ইঁদুরের কিচকিচি শব্দ শোনা গেল। যুক্তির ওপর নির্ভর করার ফল হাতে হাতে পেলাম। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে গেলাম। ভয়ে অস্থির হয়ে চেচামেচি করলাম না। চোঁচামেচি করে অবিশ্যি কোনো লাভও হত না। দশ বছর বয়স হবার পরই আমি থাকতাম। একা। সর্দার চাচা থাকতেন গেটের কাছে দারোয়ান এবং মালিদের জন্যে যে ঘরগুলো আছে–তার একটিতে।
মাস্টার সাহেবের মৃত্যুর প্রায় মাস দুই পরের ঘটনা। খাওয়াদাওয়া করে ঘুমুতে গেছি। সর্দার চাচা বললেন, ছিটকিনি লাগাও।
আমি ছিটিকিনি লাগালাম। সর্দার চাচা তাঁর অভ্যাসমতো বললেন, ভালো কইরা দেখ ঠিকমতো লাগছে কি না।
আমি আরেকবার দেখলাম। ঠিকমতোই লেগেছে।
এখন বাতি নিভাও। বাতি নিভাইয়া ঘুমাও।
আমি বাতি নিভিয়ে চারদিক অন্ধকার করে ঘুমুতে গেলাম। আপনাকে বলা হয় নি, আমার বাবা শব্দ যেমন সহ্য করতে পারতেন না, তেমনি আলোও সহ্য করতে পারতেন না। তার ধারণা, আলোতে কুকুর ভালো দেখতে পায় না। অন্ধকারে ভালো দেখে। কাজেই রাত এগারোটার পর এ বাড়ির সব বাতি নেভানো থাকতে হবে। একটি বাতিও জ্বলবে না।