কিছু কিছু জায়গা নতুন লেখা হয়েছে। সেগুলো পেনসিলে লেখা এবং তারিখ দেওয়া।
মানুষের অনেক বৈচিত্ৰ্যময় ছেলেবেলা থাকে। ম্যাক্সিম গোর্কির ছেলেবেলা কেটেছে তার দাদিমার সঙ্গে পথে পথে ভিক্ষা করে। আমার ছেলেবেলার শুরুটা ছিল। সরল ঘটনাবিহীন।
আমি ছিলাম সঙ্গীহীন, বন্ধুহীন। বিরাট কম্পাউন্ডের বাড়ি। জেলখানার দেয়ালের মতো উঁচু দেয়াল। খেলার জন্যে অনেক জায়গা, তবুও আমাকে বন্দি থাকতে হত আমার নিজের ঘরে। বারান্দায় বা উঠোনে কিংবা বাড়ির পেছনে খেলতে গেলেই দোতলা থেকে আমার বাবা দেখে ফেলতেন এবং চিৎকার করে বলতেন, ভেতরে যাও, ভেতরে যাও। আমি দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যেতাম।
নিঃসঙ্গ শিশু নিজের খেলার সঙ্গী নিজেই তৈরি করে নেয়। আমার অনেক কাল্পনিক সঙ্গী-সাথী ছিল। এদের সঙ্গেই খেলতাম। গল্প করতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল খাটের নিচের অন্ধকার কোণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি খাটের নিচে বসে কাটিয়েছি। মাঝে মাঝে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম।
আমাকে দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল সর্দার চাচার। আপনাকে আগেই তাঁর কথা বলেছি। তিনি সারাক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখতেন। বাড়িতে সর্দার চাচা ছাড়াও আরো কিছু মানুষজন ছিল, মালি ছিল। দারোয়ান ছিল। রান্নার লোক ছিল। তাদের কেউ আমার কাছে আসতে পারত না। সর্দার চাচা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠতেন।
বাবা সর্দার চাচাকে খানিকটা সমীহ করতেন। মাঝে মাঝে সর্দার চাচা আমাকে বাগানে খেলার জন্যে নিয়ে যেতেন। কুয়োতলায় নিয়ে যেতেন। ছবি আঁকার জন্যে। দোতলা থেকে বাবা আমাকে দেখতে পেতেন, কিন্তু ভেতরে যাও ভেতরে যাও বলে উঠতেন।
যে জন্ম থেকেই নিঃসঙ্গ সে নিঃসঙ্গতার কষ্ট জানে না। আমিও জানতাম না। মার জন্যে আমার কোনো আকর্ষণ ছিল না। তিনি আমার ভেতর কোনো সুখস্মৃতি তৈরি করে যেতে পারেন নি। মার কথা মনে হলেই ভয়ংকর এক স্মৃতি ধক করে মনে হত। পরিষ্কার দেখতে পেতাম মা আমার গলা চেপে ধরে আছেন। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ছোট্ট বুক ধক করে ফেটে যাবে। এই অবস্থা থেকে আমার বাবা উদ্ধার করেন। তিনিই আমাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যান।
আমি যে কদিন হাসপাতালে ছিলাম, সে কদিন আমার বাবা আমার পাশেই ছিলেন। যতবার আমি চোখ মেলেছি ততবারই আমি দেখেছি বাবা ব্যথিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হাসপাতালের ঐ কটি দিনই ছিল আমার শৈশবের শ্রেষ্ঠতম সময়।
পারিবারিক অবস্থার কথা বলি—আমরা কয়েক পুরুষের বনেদি ধনী। মুসলমানরা তিন পুরুষের বেশি তাদের ধন ধরে রাখতে পারে না। আমার বাবা হলেন তৃতীয় পুরুষ। যৌবনে তিনি ব্যবসাপতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। বেশিরভাগ ব্যবসাই বিক্রি করে নগদ টাকা করলেন। টাকা ব্যাংকে জমা করলেন। কয়েকটা বড় বড় বাড়ি কিনলেন। শহরে জমি কিনলেন। তার দূরদৃষ্টি ছিল—তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এইসব জমি হীরের দামে বিক্রি হবে।
আমার বাবাও আমার মতোই নিঃসঙ্গ ছিলেন। তিনি কারো সঙ্গে মিশতেন না। আমি আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজনকে এ বাড়িতে আসতে দেখি নি। আত্মীয়দের বাড়িতে বাবার যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। বাবা খানিকটা অসুস্থও ছিলেন। আপনাকে হয়তো ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে–উনি শব্দ সহ্য করতে পারতেন না। শব্দ শুনলেই তার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হত। তা ছাড়া তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল সবাই তাকে খুন করার জন্যে ষড়যন্ত্র করছে। চার দেয়ালের বাইরে বের হলেই তাকে খুন করা হবে। তিনি ঘরের বাইরে বের হওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিলেন। কাউকে তিনি বিশ্বাস করতেন না। দুদিন পরপর দারোয়ান বদলাতেন, মালি বদলাতেন। একসময় কুকুর পুষতে শুরু করলেন। প্রথমে এল সরাইলের দুটি কুকুর। গ্লে হাউন্ড জাতীয় কুকুর–ভয়ংকর রাগী। মালি এবং দারোয়ানের সংখ্যা কমতে লাগল, কুকুরের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
বাবার সঙ্গে আমার কোনো রকম যোগাযোগ ছিল না। তবে কালেভদ্রে তিনি আমাকে
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। বাবা আমার সঙ্গে কথা বলতেন নিচু গলায় এবং কিছুটা আদুরে স্বরে। তবে কখনো আমার দিকে তাকাতেন না। কথাবাতাঁর একটা নমুনা निछि :
বাবা বললেন, কেমন আছিস?
আমি বললাম, ভালো।
বোস।
আমি কোথায় বসব বুঝতে পারছি না। ঘরে একটা মাত্র খাট। সেখানে বসার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ বাবা বসে আছেন। তা ছাড়া খাটের এক মাথায় দোনলা বদুক। বাবা সব সময় গুলিভরা বদুক মাথার কাছে রাখতেন। আমি ইতস্তত করছি-বাবা খাটের এক অংশ দেখিয়ে বসার জন্যে ইশারা করলেন। আমি বসলাম।
পড়াশোনা হচ্ছে?
জি।
বাড়িতে মাস্টার আসে?
জি।
(সেই সময় আমার জন্যে প্রাইভেট মাস্টার রাখা হয়েছে। তিনি বাসায় এসে আমাকে পড়িয়ে যান। তাঁর কথা আপনাকে বলেছি। এবং টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে।)
মাস্টারটা কেমন?
ভালো।
মোটেই ভালো না। অতি বদলোক। সাবধানে থাকবি। বদ মতলবে ঢুকেছে। খুনখারাবি করবে।
এটা হচ্ছে বাবার সাধারণ কথার একটি। পৃথিবীর সব মানুষই তার কাছে বদমানুষ। পৃথিবীর সবাই খুনখারাবির মতলব নিয়ে ঘুরছে। আমি বাবার কথার কোনো জবাব দিলাম না। মাথা নিচু করে শুনে গেলাম।
বাবা বললেন, তোকে সাবধান করার জন্যেই ডেকেছি। খুব সাবধান থাকবি। খুব সাবধান।
জি আচ্ছা।
তোর মাস্টারের দরকারই বা কী? নিজে নিজে পড়তে পারবি না?