লজিক ব্যবহার করার আপনার অস্বাভাবিক ক্ষমতার সঙ্গে আমাদের অল্প সময়ের ভেতর পরিচয় হল। শার্লক হোমস-এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। কোনান ডায়ালের উপন্যাসের মাধ্যমে। শার্লক হোমস কল্পনার চরিত্র। আমরা বাস্তবের একজন সাধারণ মানুষকে দেখলাম যার চিন্তাশক্তি এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা অতিমানব পৰ্যায়ের।
আপনার নিশ্চয়ই মনে নেই ক্লাসে আপনি একটি এ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। আমরা সবাই এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলাম। আপনি আমার খাতা দেখে খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, তুমি ক্লাসের পরে আমার সঙ্গে দেখা করো। আমি দেখা করতে গেলাম। আপনি বললেন, এত সুন্দর হাতের লেখা কেন? আপনার প্রশ্নের ভঙ্গি এমন যেন সুন্দর হাতের লেখা হওয়া দূষণীয়। আমি বললাম, স্যার, সুন্দর হাতের লেখা কি অপরাধ?
আপনি হাসতে হাসতে বললেন, না, অপরাধ হবে কেন? তবে হাতের লেখার দিকে তুমি অস্বাভাবিক নজর দিচ্ছি। এটাই আমাকে বিস্মিত করছে। যাদের মনের ভেতরের অবস্থাটা থাকে বিশৃঙ্খল, এবং হয়তো বা অসুন্দর তারা বাইরের পৃথিবীটাকে সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল দেখতে চায়, যে কারণে হাতের লেখার মতো তুচ্ছ একটি বিষয়েও তাদের অপরিসীম মনোযোগী হাতে দেখা যায়। তোমার কি কোনো সমস্যা আছে?
আমি বললাম, না।
আমি যে মিথ্যা বলছি আপনি তা সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললেন। সেটা আমি আপনার হাসি দেখেই বুঝলাম। তবে আপনি আমাকে মিথ্যা বলার জন্যে অভিযুক্ত করলেন না। শান্ত গলায় বললেন, তোমার রিপোর্টটি পড়ে আমি আনন্দ পেয়েছি। সবাই বইপত্র ঘেঁটে রিপোর্ট তৈরি করার চেষ্টা করেছে। একমাত্ৰ তুমিই—নিজে যা ভেবেছ তাই লিখেছ।
রিপোর্টের বিষয়বস্তু ছিল—Strange dreams বা অদ্ভুত স্বপ্ন। আমি আমার নিজের দেখা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন লিখে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।
আমি বললাম, স্যার, আমার ব্যাখ্যা কেমন হয়েছে?
আপনি বললেন, বায়াস্ড ব্যাখ্যা হয়েছে। যেহেতু তুমি স্বপ্নটি দেখেছ, সেহেতু তুমি তা ব্যাখ্যা করেছ নিজের দিকে পক্ষপাতিত্ব করে। আমি অন্য ব্যাখ্যা করব।
আপনার ব্যাখ্যা কী স্যার?
আপনি বললেন, আমার ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে আমাকে জানতে হবে তুমি আসলেই এ জাতীয় স্বপ্ন দেখেছি কি না। মানুষ কখনো তার অভিজ্ঞতার বাইরে স্বপ্ন দেখে না, মানুষের কল্পনা অভিজ্ঞতার ভেতর সীমাবদ্ধ। একজন শিল্পীকে তুমি যদি দৈত্যের ছবি আঁকতে দাও-সে এক চোখ এক দৈত্যের ছবি আঁকবে–যার দুটি শিং আছে। তুমি খুব মন দিয়ে লক্ষ করলে দেখবে-দৈত্যের হাত-পা দেখাচ্ছে মানুষের মতো। কপালে চোখটা বিড়ালের মতো, মাথার শিং দুটি গরুর মতো। অর্থাৎ শিল্পী তাঁর অভিজ্ঞতাই কল্পনায় ব্যবহার করেছেন। দৈত্যের ছবিতে তুমি এক শিঙের দৈত্য পাবে কিন্তু তিন শিঙের দৈত্য সচরাচর পাবে না। কারণ মানুষ একশিঙের প্রাণী দেখেছে-যেমন গণ্ডার, দু শিঙের প্রাণী দেখেছ গরু, ছাগল কিন্তু তিন শিঙের প্রাণী দেখে নি। বুঝতে পারছ কী বলছি?
পারছি স্যার।
কিন্তু তুমি যে স্বপ্ন দেখেছ বলে লিখেছ এই স্বপ্ন তুমি দেখতে পার না। এই স্বপ্ন মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।
আমি বললাম, আমি এই স্বপ্ন দেখেছি স্যার।
আপনি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। যদি কখনো বড় ধরনের সমস্যার পড় আমার কাছে এস।
আপনার কি মনে পড়ে। আপনি এ জাতীয় একটি আশ্বাসবাণী আপনার একজন ছাত্রকে দিয়েছিলেন? হয়তো আপনার মনে নেই। আমি কিন্তু মনে করে রেখেছি। এবং সব সময় আপনার খোঁজ রেখেছি। গত সাত বছরে আপনি কোন কোন বাসায় ছিলেন, কতদিন ছিলেন–সব আমি একের পর এক বলে দিতে পারব। এর পরেও আমাকে আপনার অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
স্যার, সমস্যার আমি এখন পড়ি নি। সমস্যার পড়েছিলাম ছেলেবেলাতেই। সেই সমস্যা আমি আমার নিজের মতো করে সমাধান করার চেষ্টা করেছি। আমাকে সাহায্য করেছেন আমার একজন গৃহশিক্ষক। যিনি জীবিত নন। মৃত। মৃত মানুষটি এখনো আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। আপনার মতো যুক্তিবাদী মানুষের কাছে নিতান্তই অযৌক্তিক একটি বিষয় উত্থাপন করলাম। করলাম, কারণ, আপনি বলেছেন মানুষ যে কোনো প্রশ্নের উত্তর হিসেবে হ্যাঁ এবং না। দুটিই গ্ৰহণ করে। আমি আমার গৃহশিক্ষকের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তার আগে আমার কিছু কথা জেনে নিতে হবে।
আমি নিজে আমার কথা ছাড়া ছাড়া ভাবে আপনাকে কিছু বলেছি। আপনি নিজেও অনুসন্ধান করে কিছু কিছু বের করার চেষ্টা করেছেন। এতে লাভ তেমন হয় নি। আপনি বিভ্ৰান্ত হয়েছেন। আপনি আমার মার সঙ্গে কথা বলেছেন–তাকে আপনার নিশ্চয়ই সরল সাদাসিধে মহিলা মনে হয়েছে। তিনি মোটেই সে রকম নন। আমার বাবা মাকে পরিত্যাগ করেছিলেন, কারণ তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন–আমার মা গালাটিপে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করছেন। এতে আমার শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে। রেখে আমার চিকিৎসা করতে হয়। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আমার বয়স চার চার বছরের স্মৃতি শিশুর মনে থাকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে।
স্যার, আপনি অনেকক্ষণ একনাগাড়ে আমার লেখা পড়লেন। এখন আপনি বিশ্রাম করুন। বাকিটা কাল পড়বেন।
মুশফেকুর রহমানের খাতা
মিসির আলি মুশফেকুর রহমানের খাতা নিয়ে বসেছেন। এখন পড়ছেন। শৈশব স্মৃতি। খুবই গোছানো লেখা। একটিও বানান ভুল নেই। কাটাকুটি নেই। বোঝাই যাচ্ছে এই অংশ অনেকদিন আগে লেখা। কাগজ পুরোনো হয়ে গেছে। লেখার কালি বিবর্ণ। তবে তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা।