রাতে ঘুমের ঠিক না থাকলেও তাঁর ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। ঘুম ভেঙে পার্কে বেড়াতে যান। দুপুরে খাওয়ার পর দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। বিকেলে পার্কে গিয়ে বসেন। তার বসার নির্দিষ্ট বেঞ্চ আছে। পা তুলে বেঞ্চিতে বসে তিনি গাছপালার সৌন্দৰ্য দেখতে চেষ্টা করেন, যদিও গাছপালা তাকে কখনোই আকৃষ্ট করে না। ডাক্তার হালকা বই পড়তে বলেছে। তিনি হাসি হাসি হাসি এই নামে তিন শ পৃষ্ঠার বই কিনে এনেছেন। বইটিতে দু হাজার একটি জোক আছে। তিনি প্রথম পৃষ্ঠা থেকে পড়ে পড়ে এখন তেত্রিশ পৃষ্ঠায় এসেছেন—এখনো তার হাসি আসে নি। এই বইটির দাম পড়েছে এক শ টাকা। মনে হচ্ছে এক শ টাকাই পানিতে গেছে।
আরেকটি বই ফুটপাত থেকে কিনেছেন দুটাকা দিয়ে। বইটির নাম বেহুলার স্বাসরঘরের ইতিহাস। এই বইটি বরং ভালো। অনেক চিন্তাভাবনা করার ব্যাপার আছে। যেমন লখিন্দরের বাবার নাম চাঁদ সদাগর। চাঁদ সদাগর সম্পর্কে বলা হচ্ছে–
কালীদহে পড়ে চাঁদ পান করে জল
ক্ষণকাল যায় ভেসে ক্ষণে হয় তল।
সপ্তদিন নবম রাত্ৰি ভাসিল সাগরে
ইচামাছ বাসা বঁধে দাড়ির ভিতরে… ।
অর্থাৎ চাঁদ সদাগরের দাড়িতে ইচামাছ বাসা বেঁধেছে। সাগরের ইচা মাছ হচ্ছে গলদা চিংড়ি। এরা কী করে দাড়ির ভেতর বাসা বাঁধবে? রূপক অর্থে বলা হচ্ছে? রূপকের চিত্ৰকল্প তো বাস্তব হওয়া উচিত। অবাস্তব চিত্রকল্প দিয়ে রূপক তৈরি করার মানে কী? তা ছাড়া সপ্তদিন নবম রাত্ৰি ভাসিল সাগরে বাক্যটির মানেই বা কী? সপ্তদিন সাগরে ভাসলে সপ্তরাতও ভাসতে হবে। অবিশ্যি শুরুতে এক রাত ভেসেছে এবং শেষে এক রাত ভেসেছে এই ভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। তাতেও শেষ রক্ষা হয় না, কারণ চাঁদ সাদাগরের নৌকাডুবি রাতে হয় নি। হয়েছে দিনে।
মিসির আলি পার্কে তাঁর নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসে আছেন। তার পাশে দুটি বই। একটি হল বেহুলার বাসরঘরের ইতিহাস, অন্যটি–The Birds, Their habits. তিনি সব বই পড়ছেন না। বেশ আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখছেন। বাচ্চারা ফুটবল খেলছে। ফুটবল খেলার মতো ফাঁকা জায়গা এই পার্কে নেই। চারদিকে গাছগাছালি। এর মধ্যেই বাচ্চারা খেলছে। কে কোন দলে খেলছে। এটা বের করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেরাও যার যেদিকে ইচ্ছা বলে কিক বসাচ্ছে। নির্ধারিত কোনো গোলপোষ্ট আছে বলেও মনে হচ্ছে না। গোলকিপার যে দুটি গোলপোষ্টের মাঝখানে দাঁড়াচ্ছে সেটাই গোলপোষ্ট। বলের সঙ্গে সঙ্গে গোলপোষ্টের স্থান বদল হচ্ছে।
স্নামালিকুম স্যার।
মিসির আলি না তাকিয়েই বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি স্যার?
এখন বলতে পারেন না। এখন আমি খেলা দেখছি।
স্যার, আমি বসি না হয়।
বসুন।
অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত খেলা চলল। কে জিতল কে হারুল কিছু বোঝা গেল না। মনে হচ্ছে দুদলই জিতেছে। এও এক অসাধারণ ঘটনা। একসঙ্গে দুটি দলকে জিততে প্রায় কখনোই দেখা যায় না।
স্যার, আমি অনেকক্ষণ বসে আছি।
মিসির আলি তাকালেন। তাঁর ভুরু কুঞ্চিত হল। মানুষের সঙ্গ তাঁর কাছে কখনোই বিরক্তিকর ছিল না। অতি সাধারণ যে মানুষ তার চরিত্রেও অবাক হয়ে লক্ষ করার মতো কিছু ব্যাপার থাকে। কিন্তু ইদানীং মানুষ র্তার কাছে অসহ্য বোধ হচ্ছে। বরং চড়ুই পাখির ব্যাপার তাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করছে। তার পাশে বসে থাকা চশমা পরা মানুষটি মাঝে মাঝেই তাকে বিরক্ত করছে। তাকে এই পার্কেই দেখা যায়। সবদিন না, কয়েকদিন পরপর। এই লোক তঁকে একটা গল্প বলতে চায়। তাও প্রেমের গল্প। পার্কে বসে প্রেমের গল্প শোনার মতো ধৈর্য এবং ইচ্ছা কোনোটাই তার নেই। এ লোককে সে কথা অনেকবারই বলা হয়েছে। মিসির আলি ঠিক করলেন, আজ আরেক বার বলবেন। প্রথমে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করবেন–তারপর কঠিন এবং রূঢ়ভাবে বলবেন।
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ, এখন বলুন কেমন আছেন?
কঠিন কথা বলার আগে সহজভাবে শুরু করা। বুদ্ধিমান লোক হলে বুঝে ফেলা উচিত যে প্রস্তাবনা মূল বইয়ের মতো নয়।
জি স্যার, ভালো আছি।
গল্প শোনাতে চাচ্ছেন তো? কিছু মনে করবেন না। গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে না।
আপনার চড়ুই পাখি দুটি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম।
চড়ুই পাখি?
জি স্যার, পরশুদিন আপনার কাছে এসেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, আপনি আমার কোনো কথা শুনতে পারবেন না! চড়ুই পাখি নিয়ে ব্যস্ত। পাখি দুটি কি ভালো আছে?
হ্যাঁ, ভালো আছে।
এখনো কি পুরুষ পাখিটা খাচ্ছে এবং মেয়ে পাখি দূরে বসে দেখছে?
হ্যাঁ।
স্যার, আমি ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেছি। আমার মনে হয় পাখি দুটাকে যদি আমরা খাঁচায় আটকে ফেলতে পারি তা হলে বোঝা যাবে ব্যাপারটা কী? খাঁচায় চাল দেওয়া থাকবে–ক্রমাগত চব্বিশ ঘণ্টা মনিটর করা হবে। যদি দেখা যায়। খাচার ভেতরও মেয়ে পাখিটা কিছুই খাচ্ছে না–তখন বুঝতে হবে…
মিসির আলি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, খাঁচায় এদের ঢোকাব কী করে?
খাঁচায় ঢোকানো সমস্যা হবে না, স্যার। চাল খাইয়ে খাইয়ে আপনি এদের অভ্যস্ত করে রেখেছেন- খাচার দরজা খুলে আপনি যদি এর ভেতর চাল দিয়ে দেন-পাখি দুটা খাঁচায় ঢুকবে।
মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে বললেন, খাঁচা কোথায় পাওয়া যায়?
নীলক্ষেতে ইউনিভার্সিটি মার্কেট নামে একটা নতুন মার্কেট হয়েছে। রঙিন মাছ, পাখি, পাখির খাচার অসংখ্য দোকান।