মিসির আলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটি কথা বলছে এমনভাবে যে জিহ্বা দেখা যাচ্ছে না। তবু মিসির আলি লক্ষ করলেন ছেলেটির জিহ্বা কালো নয়। অন্য দশজনের মতোই।
মুশফেকুর রহমান বলল, স্যার, আপনি হেডমাস্টারদের মতো আমাকে দেখছেন। কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন।
আপনার জিহ্বার রঙ কালো না।
দিনের বেলা রঙ ঠিক থাকে।
কেন?
আপনি বলুন কেন?
আপনি কি কোনো রঙ মাখেন?
জি স্যার, মাখি। এক ধরনের এজো ডাই-নাইট্রোজেন ঘটিত জৈব রঙ। দিনের বেলা লোকজনের সামনে কালো জিব নিয়ে বেরুতে ইচ্ছা করে না।
আপনার বয়স কত?
তেত্রিশ। স্যার, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।
বেশ বলব।
আপনাকে আজ আর বিরক্ত করব না। শরীর সারুক। আমি সব সময় খোঁজ রাখছি।
থাংক ইউ।
পাখিবিষয়ক বইটি কি নেড়েচেড়ে দেখেছেন?
আমি গোড়া থেকেই পড়ছি-পঞ্চাশ পৃষ্ঠার মতো পড়া হয়েছে।
বই পড়তে কষ্ট হয় না?
না। তবে সন্ধ্যার পর কিছু পড়তে পারি না। তখন চোখ জ্বালা করে, মাথায় যন্ত্রণা হয়।
মুসফেকুর রহমান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, স্যার, আমি আমার কিছু ঘটনা লিখে এনেছি। পড়তে যাতে আপনার কষ্ট না হয় সে জন্যে ভাগ ভাগ করে লিখেছি। প্রতিটি চ্যাপ্টারের শেষে আমি আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও করেছি। আপনার ইচ্ছা না হলে ব্যাখ্যাগুলো পড়ার দরকার নেই।
মিসির আলি বললেন, কী ধরনের ব্যাখ্যা?
একজন মনোবিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা।
মনোবিজ্ঞানে তোমার কী কিছু পড়াশোনা আছে?
মুশফেকুর রহমান বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, সামান্য আছে। আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। এই বিষয়ে এম. এ. করেছি।
কোন সনের ছাত্র?
বলতে চাচ্ছি না, স্যার।
মিসির আলি বললেন, তুমি কি কখনো আমার ছাত্র ছিলে?
জি ছিলাম। গোড়া থেকে এই কারণেই আপনাকে স্যার ডাকছি। আপনার কাছে আসার আমার কারণও এইটিই। স্যার, আজ আমি উঠি?
তোমার ঐ ঠোঙায় কী আছে?
কিছু বেদানা নিয়ে এসেছি। টাইম পত্রিকায় পড়েছিলাম–বেদানায় আছে ভিটামিন K, রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরিতে ভিটামিন কে খুব কাজ করে। নার্সকে বলে। দিয়েছি, ও বেদানার রস তৈরি করে আপনাকে দেবে। স্যার যাই।
মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন। হালকা নীল শার্ট পরা, মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুলের এই যুবকটিকে কী সুন্দর লাগছে! কিন্তু সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে! আগেও একবার খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছেন। সেবার বাঁদিকে ঝুঁকে হাঁটছিল। এখন হাঁটছে ডানদিকে ঝুঁকে।
স্যারদের নামের আগে শ্ৰদ্ধেয়
শ্রদ্ধেয় স্যার,
স্যারদের নামের আগে শ্ৰদ্ধেয় ব্যবহার করা আমাদের প্রাচীন রীতি। যদিও এই সমাজের বেশিরভাগ শিক্ষকরাই শ্ৰদ্ধেয় বিশেষণ দাবি করেন না। স্কুলে আমাদের একজন অঙ্ক স্যার ছিলেন। তিনি খুব ভালো অঙ্ক জানতেন। ছাত্রদের বুঝাতেনও খুব সুন্দর করে। তিনি আমাকে ডাকতেন–সৰ্প-শিশু! মাঝে মাঝেই মজা করার জন্যে আমাকে বলতেন, এই কর তো! হা করে তোর কুচকুচে কালো জিহাটা নড়াচড়া কর। দেখি কেমন লাগে।
আমি তাই করতাম। তিনি মজা পেয়ে হো হো করে হাসতেন। এই শিক্ষককে কি শ্ৰদ্ধেয় বলা ঠিক হবে?
আমি আপনার নামের আগে বহুল-ব্যবহৃত বিশেষণ ব্যবহার করেছি। এর চেয়ে সুন্দর কিছু ব্যবহার করতে পারলে আমার ভালো লাগত। আপনি অল্প কিছুদিন আমাদের ক্লাস নিয়েছেন। পড়াতেন এবনারমাল বিহেভিয়ার। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আমি তোমাদের এবনারমাল বিহেভিয়ার পড়াতে এসেছি। পড়ানোর সময় কী করলে আমার আচরণকে তোমরা এবনারমাল বলবে?
আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। ছাত্র হিসেবে আমরা আপনাকে যাচাই করে নিতে চাচ্ছিলাম। আপনি বললেন, আচ্ছা, আমি যদি এই টেবিলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেই–তা হলে কি তোমরা আমার আচরণকে এবানরমাল বলবে?
একজন ছাত্র বলল, হ্যাঁ।
আপনি বললেন, প্রাচীন গ্রিসে কিন্তু ক্লাসরুমে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার প্ৰচলন ছিল। তারা মনে করুত শিক্ষক সবচেয়ে সম্মানিত। তাকে দিতে হবে সবচেয়ে সম্মানের স্থান। তাদের কাছে টেবিলে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়াটাকে অস্বাভাবিক আচরণ মনে হত না। কোনো শিক্ষক যদি মেঝেতে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন সেইটা হতো অস্বাভাবিক। কাজেই অস্বাভাবিকের সংজ্ঞা কী? সংজ্ঞা হল-আমরা যা দেখে অভ্যস্ত তার বাইরে কিছু করাটাই অস্বাভাবিক।
মজার ব্যাপার হল মানুষ খুব অস্বাভাবিক একটি প্রাণী, অথচ আমরা মানুষের কাছে স্বাভাবিক আচরণ আশা করি। আচ্ছা, তোমরা একজন কেউ বল তো, মানুষ অস্বাভাবিক প্রাণী কেন?
ক্লাসের কেউ কথা বলল না। আপনি হাসিমুখে বললেন, মানুষ অস্বাভাবিক তার কারণ মানুষের মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক একই সঙ্গে লজিক এবং এন্টি-লজিক নিয়ে কাজ করে। প্রতিটি প্রশ্নের দুটি উত্তর সে সমান গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে-একটি হ্যাঁ, অন্যটি না। সে মনে করে দুটি উত্তরই সত্য। তা হয় না।
প্রশ্ন : ঈশ্বর বলে কি কিছু আছেন? উদাহরণ দেই।
উত্তর : হ্যাঁ এবং না।
প্রশ্ন : আমরা কি শূন্য থেকে এসেছি?
উত্তর : হ্যাঁ এবং না।
প্রশ্ন : আমরা কি শূন্যতে মিশে যাব?
উত্তর : হ্যাঁ এবং না।
স্যার, আপনি ঝড়ের গতিতে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন এবং নিজেই উত্তর দিচ্ছেন-হ্যাঁ এবং না। আমরা মুগ্ধ ও বিস্মিত। ক্লাসের শেষে আপনার নাম হয়ে গেল হ্যাঁ-না স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার, এই নাম আমরা কখনো ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার করি নি। এই নাম উচ্চারণ করেছি। শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়।