কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব?
জি ভালো।
আপনার জ্বর পুরোপুরি রেমিশন হয়েছে। আপনি আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
মিসির আলি চোখ খুললেন। আলো এখন আর আগের মতো চোখে লাগছে না। তার বিছানার পাশে যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন ডাক্তার। গলায় ষ্টেথিসকোপ ঝুলানো দেখে তাই মনে হয়। নার্স্যরাও ষ্টেথিসকোপ ব্যবহার করে, তবে তারা কখনো গলায় পরে না।
মিসির আলি বললেন, আমি প্রচণ্ড খিদে বোধ করছি।
আপনি খিদে বোধ করছেন। এটা খুবই সুলক্ষণ। হালকা কিছু খাবার দিতে तलछेि।
এটা কি হাসপাতাল?
হাসপাতাল তো বটেই। তবে প্রাইভেট হাসপাতাল।
আমি কতদিন ধরে আছি?
আজ হচ্ছে ফিফথ ডে। আপনার অবস্থা এমন ছিল যে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম। আপনি কমায় চলে যাচ্ছেন।
মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, কমা-সেমিকেলনে আমি যাব না। যদি যেতে হয় সরাসরি ফুস্টপে চলে যাব।
ডাক্তার হাসলেন। মিসির আলির মনে হল বেশিরভাগ ডাক্তার হাসেন না। তবে যারা হাসেন তারা খুব সুন্দর করে হাসেন।
মিসির আলি সাহেব!
জি।
আপনি বিশ্রাম করুন! চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।
আজকের একটি খবরের কাগজ কি পেতে পারি?
অবশ্যই পেতে পারেন। তবে আমার মনে হয় খবরের কাগজ পড়ার চেয়ে বিশ্রাম আপনার জন্যে অনেক জরুরি। নাশতা খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিন। চোখ বন্ধ করে ফেলুন।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর অনেক কিছু জানার ছিল। কে তাঁকে এমন এক আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিল? ঘরের যা সাজসজ্জা তাতে মনে হয় হাজারখানেক টাকা হবে দৈনিক ভাড়া। দেয়ালে ছোট্ট বারো ইঞ্চি টিভি দেখা যাচ্ছে। রোগীর বিনোদনের ব্যবস্থা। ঘরের দেয়াল, মেঝে সবই ঝকঝকি করছে। কোথাও কোনো ঘড়ি নেই। টিভির চেয়েও ঘড়ির প্রয়োজন ছিল বেশি। কোন এক বিচিত্র কারণে অসুস্থ হলেই ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করে।
নার্স নাশতা নিয়ে এল। এক স্নাইস রুটি। ডিম পোচ, একটা কমলা। গরম এক কাপ চা।
মিসির আলি বললেন, সিগারেট কি খাওয়া যাবে সিস্টার?
না, সিগারেট খাওয়া যাবে না। এটা হাসপাতাল, ধূমপান মুক্ত এলাকা।
গরম চায়ের সঙ্গে একটা সিগারেট খেতে পারলে আমার অসুখ পুরোপুরি সেরে যেত বলে আমার ধারণা।
এখানকার ডাক্তারদের সে রকম ধারণা না। কাজেই সিগারেট খেতে পারবেন না। নাশতা খেয়ে নিন। আপনার গা আমি স্পঞ্জ করে দেব।
এই রুমটার ভাড়া কত?
প্ৰতিদিন পনের শ টাকা।
মিসির আলির মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি হাজার টাকায় তিনি এবং বদু সারা মাস চালান। তার মধ্যে বাড়িভাড়া ধরা আছে।
নার্স কঠিন মুখ করে বলল, বড়লোকদের চিকিৎসার খুব ভালো ব্যবস্থা বাংলাদেশে আছে।
মিসির আলি বললেন, অবশ্যই আছে। তবে মজার ব্যাপার কি জানেন সিস্টার–এত করেও বড়লোকরা কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পান না। গরিবরা যেভাবে মরে তাদেরও ঠিক একইভাবে মরতে হয়।
এখন হয়, একদিন হয়তো হবে না। দেখা যাবে অমর হবার ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। ত্ৰিশ লক্ষ চল্লিশ লক্ষ টাকা দাম। শুধু বড়লোকরা সেই ওষুধ কিনতে পারছে।
মিসির আলি তার গোছানো কথায় চমৎকৃত হলেন। অধিকাংশ মানুষই আজকাল গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। চিন্তা এলোমেলো থাকে বলে কথাবার্তাও থাকে এলোমেলে।
সিস্টার, আপনার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে। আমি আপনার পরামর্শ ও সাহায্য চাচ্ছি। আমার পক্ষে প্রতিদিন পনের শ টাকা ভাড়া দিয়ে এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমি দরিদ্র মানুষ। একদিনের ভাড়া কী করে দেব তাই বুঝতে পারছি না। আমি আজই এখান থেকে বিদেয় হতে চাই। সেটা কী করে সম্ভব তা আপনি দয়া করে বলে দেবেন। যে টাকা আপনার পান তাও একসঙ্গে আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। আমাকে ভাগে ভাগে দিতে হবে। তার একটা এ্যারেঞ্জমেন্টও করতে হবে।
স্যার, আপনাকে এসব নিয়ে মোটেই ভাবতে হবে না। আমাদের হাসপাতালের নিয়ম হচ্ছে—ভর্তি হবার সময়ই পুরো টাকা দিতে হয়। আপনার বেলাতেও তাই হয়েছে। কেউ-একজন নিশ্চয়ই পুরো টাকা দিয়েছেন।
সেই কেউ-একজনটা কে?
আমি তো স্যার বলতে পারব না। আপনি চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি।
দয়া করে খোঁজ নিয়ে দেখুন।
নার্স কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। তার হাতে একটি বই, একটি মুখ বন্ধ খাম।
স্যার, যিনি আপনাকে এখানে ভর্তি করিয়ে গেছেন, তার নাম মুশফেকুর রহমান। তিনি আপনার জন্যে বইটা রেখে গেছেন। চিঠিও রেখে গেছেন। আর স্যার আমি খোঁজ নিয়েছি–আপনার জন্যে পনের দিনের রুম পেমেন্ট করা আছে। তার আগেই যদি আপনি চলে যান তা হলে টাকাটা রিফান্ড করা হবে।
মিসির আলি চিঠি পড়লেন। সুন্দর হাতের লেখা। এই লেখা দেখে আগেও একবার মুগ্ধ হয়েছিলেন, আজো হলেন।
শ্ৰদ্ধেয় স্যার,
আপনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমি আপনাকে এই প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে এসেছি। আপনার বিনা অনুমতিতেই এটা করতে হল। কারণ অনুমতি দেওয়ার মতো অবস্থা আপনার ছিল না।
আপনার পাখি দুটি আমি আমার নিজের কাছে নিয়ে রেখেছি। আপনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা আমি চালিয়ে নিতে চেষ্টা করছি। ফলাফল এখন পর্যন্ত শূন্য। দুটি পাখিই খাচ্ছে। আমি আরো কয়েকদিন দেখব।
আপনি অসুস্থ অবস্থায় নীলু। নীলু বলে ডাকছিলেন। ভদ্রমহিলার ঠিকানা জানার জন্যে আমি আপনার কিছু কাগজপত্র ঘাটাঘাঁটি করেছি। এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আপনার অবস্থা দেখে আমি খুবই শঙ্কিত বোধ করছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল। ঐ মহিলাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করা দরকার।