ইন্দ্রনাথের সন্ধ্যার ঘটনার কথা মনে ছিল না। তাই অবাক হয়ে বলে, মেয়েছেলে আবার কে?.
আহা, সন্ধ্যেবেলা যাদের নিয়ে দোরে পর্দা ঝুলিয়ে দুঘণ্টা কথা হলো পিসিমার!
ও আই সি! ইন্দ্রনাথ বলে, কে তারা? পিসিমার শ্বশুরবাড়ির কেউ নাকি?
কে জানে বাবু! বলে ফের তাস ভাঁজতে শুরু করে জগ।
আর ঠাকুর জানায়, পিসিমার ঘরে দাদাবাবুর খাবার ঢাকা আছে।
খাবার ঢাকা! ব্যাপার কী! পিসিমা ঠাণ্ডা খাবার খাওয়াবেন ইন্দ্রকে!
কিন্তু আজ আর খাবার ঠাণ্ডার জন্য পিসিমার কোন আক্ষেপ নেই। কারণ আজ তিনি এই তুচ্ছতার অনেক উর্ধ্বে।
ইন্দ্র বাড়ি আসবার আগে ভেবেছিল তার দেরির জন্যে পিসিমার রাগ এককথায় জল করে দেবে। কিন্তু বাড়ি ঢুকে জগর আর ঠাকুরের মারফত রিপোর্ট পেয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত, কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে ওপরে উঠল। আর নীহারকণার ঘরে ঢুকে ভয়ানক রকমের অবাক হয়ে গেল। ইন্দ্রর মনে হল তার জীবনে সে আর কখনো পিসিমার মুখের এরকম চেহারা দেখেনি।
এ চেহারা কি রাগের, না অভিমানের? না, তাও তো নয়। নীহারকণার চিরদিনের একরঙা মুখে অদ্ভুত এক ভাবব্যঞ্জনা। সে মুখে নানারঙের ছাপ–রাগের, দুঃখের, ক্ষোভের, হতাশার, বেদনার, এবং আহত আত্মাভিমানের।
কিন্তু কেন? এই অভূতপূর্ব ভাবব্যঞ্জনার কারণ যে ইন্দ্র নিজেই, একথা ইন্দ্র ভাবতে পারলে না। তাই কাছে গিয়ে আস্তে প্রশ্ন করলো,-পিসিমা এভাবে বসে যে?
নীহারকণা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শান্ত গম্ভীরভাবে বললেন, হাত মুখ ধোওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ।
খেয়ে নাও। সংক্ষিপ্ত স্নেহহীন এই নির্দেশটুকু দিয়ে নীহারকণা ইন্দ্রর জন্য রক্ষিত আহার্যগুলি গুছিয়ে টেবিলে দিয়ে দেন।
.
ইন্দ্র খেতে বসে বলে, বাবার খাওয়া হয়েছে?
না, সে আজ খায়নি। নীহারকণার স্বর উদাস।
খাননি? কেন? অসুখ করেছে?
নীহারকণা উদ্বেলিত আবেগ-তরঙ্গ কোন রকমে চেপে রেখে বলেন, অসুখ? হ্যাঁ, তা অসুখ বৈকি। বলবো সবই, বলতে তো হবেই। আগে খেয়ে নাও।
পিসিমার মুখে তুমি সম্বোধন! হঠাৎ বুকটা কেমন হিম হিম হয়ে আসে ইন্দ্রর। আর সঙ্গে সঙ্গে থালার কাছে বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বলে, শোনবার আগে তো খাবো না!
নীহারকণা আরো উদাস, আরো শান্তভাবে বলেন, খাবার আগে তো শোনাব না।
পিসিমা, কী হয়েছে বল না? কেউ কোথাও মারা গেছে নাকি?
নাঃ, মরতে আর পারা গেল কই! নীহারকণা তিক্ত ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে বলেন, শুধু মরার বাড়া হয়ে পড়ে থাকা!
ইন্দ্র এবার ব্যাকুল হয়ে ওঠে, দোহাই পিসিমা, সবাই মিলে এমন রহস্য হয়ে উঠো না তোমরা।… জগাটাও কী যে সব মাথামুণ্ডু বললো। সন্ধ্যাবেলা এসেছিল কারা সব?
আর চলে না। আর ধৈর্য ধরে থাকা যায় না। আর অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না পরম স্নেহের ভাইপোর খাওয়া সাঙ্গ হওয়া পর্যন্ত।
ফেটে পড়লেন নীহারকণা, ঢের ছলনা করেছিস ইন্দু, আর ছলাকলা করিসনে! মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে!
ছলনা!…ইন্দু!…সহ্যের সীমা!
ইন্দুই কি আজকের এই দুর্বোধ্য রহস্য-নাটকের নায়ক নাকি?
কিন্তু ব্যাপার কী?
ইন্দ্রনাথও সংহারমূর্তি ধরতে জানে। তাই চেয়ারটা ঠেলে খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলে, যাক, জানো তাহলে মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে। কিন্তু সেটা সব মানুষের পক্ষেই প্রযোজ্য পিসিমা। ঈশ্বর জানেন কী ঘটেছে তোমাদের সংসারে,…পরমাত্মীয় কেউ মরে গেছে, না নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, নাকি তোমাদের ব্যাঙ্ক ফেল হয়ে গেছে, না মামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছ তোমরা! কিন্তু তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? এমন ভাবে কথা বলছো যেন আমিই কি অপরাধ করেছি! মানে কী এর?
মানে কী এর?
মানে জানো না তুমি ইন্দ্রনাথবাবু? মানে বোঝবার ক্ষমতা হচ্ছে না তোমার? নীহারকণা যেন ধাপে ধাপে ফেটে পড়তে থাকেন আরো বেশি–আরো বেশি।
মানে বুঝছো না, তোমাকে কেন অপরাধী করা হচ্ছে?…লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করবার ক্ষমতা হয়েছে, বিয়ে হতে হতেই ছেলের বাপ হবার ক্ষমতা হয়েছে, এতবড় একটা কুকীর্তি করে দিব্যি গা ঝেড়ে ফেলে খোকা সেজে বেড়াবার ক্ষমতা হয়েছে, আর এটুকু বোঝবার ক্ষমতা হচ্ছে না যে, পাপ কখনো চাপা থাকে না! ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!
ইন্দ্ৰনাথ নিষ্পলক দৃষ্টিতে পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শোনে সমস্ত। তারপরই হঠাৎ পাখার রেগুলেটারটা শেষ প্রান্তে ঠেলে দিয়ে, বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকে–জগ, জগ, শীগগির খানিকটা বরফ নিয়ে আয় তো!
বরফ! নীহারকণা ছিটফিটিয়ে ওঠেন–ঢের সহ্য করেছি ইন্দু, আর না। খোলস ভেঙে স্বমূর্তি বেরিয়ে পড়েছে তোমার। এখন আমাকে মাথায় বরফ চাপিয়ে পাগল সাজিয়ে রাঁচী পাঠিয়ে দিলেই কি পার পাবে?..রাগে দুঃখে ঘেন্নায় লজ্জায় চন্দর তোমাকে ত্যেজ্যপুত্তুর করেছে!
চমৎকার! বাবাও এর মধ্যে আছেন? ইন্দ্রনাথ একটু ব্যঙ্গহাসি হেসে বলে, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমরা যেন আদিকালের জমিদারতন্ত্রের মধ্যে বাস করছি! তেজ্যপুত্তুর! বাঃ বাঃ! তা শূলে চড়ানো বা কেটে রক্তদর্শনের হুকুমটাই বা হয়নি কেন?
এখনো বাকচাতুরী করে দোষ ঢাকতে চাস তুই? নীহারকণা যেন ক্রমশ আগুন হারিয়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন, এখনো স্বীকার পাবি না তুই? মুখের চেহারা নিভন্ত অঙ্গারের মত হয়ে আসে।