ইন্দ্রনাথ যখন ফিরলো তখন অনেক রাত। আজ তাদের সমাজকল্যাণ সঙ্রে প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বার্ষিক সম্মেলন ছিল। অনুষ্ঠানটা ভালই হলো। সভাপতি আর প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন সাহিত্যিক প্রবোধ ঘোষ আর কবি সুজিত দত্ত।
সমাজকল্যাণের নানা নতুন ব্যাখ্যা শোনালেন তাঁরা, আলোচনা করলেন নানা দিক থেকে। বললেন, সমাজকল্যাণের মূল বনেদ হচ্ছে মানবতাবোধ। মানুষ যেদিন সমস্ত মানুষকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দিতে শিখবে, তখন আর আলাদা করে সমাজকল্যাণ সঙ্ গড়তে হবে না। সেই মানবতাবোধ আর সেই সমবোধের ভিত্তিতে যে সমাজ গঠিত হবে, সে সমাজে অকল্যাণের স্পর্শ থাকবে না।…ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরে সুস্থে চমৎকার করে বললেন। অথচ এদিকে প্রবোধ ঘোষ ভারী ব্যস্তবাগীশ। নিজের ভাষণটুকু শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সভা ত্যাগ করলেন, কারণ পর পর নাকি আরও দুটো সভা আছে। একটা কোন ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের, আর একটা কোন মহারাজজীর তিরোধান-দিবসের স্মৃতি-বার্ষিকী।
তিনটি সভা তিন জাতের। কিন্তু তিনটেতেই সমান ভাষণ-নৈপুণ্য প্রকাশ করবেন প্রবোধ ঘোষ। আশ্চর্য!
কী করে যে পারে এরা!
কবি সুজিত দত্তর কথাগুলিতে একটু বেশী মাত্রায় ভাবোচ্ছাস। কথার চাইতে কথার ফেনাই বেশি। তবু শুনতে ভাল।
অবিশ্যি যারা কান পেতে শুনতে চাইবে তাদের কাছে। নইলে বক্তৃতা আর কান দিয়ে শোনে কে? কখন পশ্চাদ্বর্তী আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি শুরু হবে, শ্রোতারা তার জন্যে ছটফট করতে থাকে। বক্তারা সময় একটু বেশি নিয়ে ফেললেই মনে মনে তাদের মুণ্ডপাত করতে থাকে। হাসে, টিটকিরি দেয়, অলক্ষ্যে বক দেখায়।
ইন্দ্ররা তো সবই জানে–সবই দেখে।
ওই জন্যেই তো অধ্যাপক সুকুমার বন্দ্যোর নাম উঠেও ভোটের অভাবে বাতিল হয়ে গেল। সঙ্রে অন্যেরা বললে, ও সর্বনাশ! সুকুমার! তার তো সেই ধরলে কথা থামায় কে! সুকুমারকে এনে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে আজকের ফাংশনই মাটি। তিনি স্থান-কাল পাত্র, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান, সব কিছু বিস্মৃত হয়ে তার প্রাণের যত কথা, হৃদয়ের যত বক্তব্য সব প্রকাশ করতে বসবেন।
কোন একটি বিখ্যাত মহিলাকে আনার ইচ্ছে ছিল সবাইয়ের, জোগাড় হলো না। মহিলাদের যে আবার মান বেশি। অনুরোধ উপরোধ করতে করতে প্রাণ যায়। তা ছাড়া আনতে যাও, রাখতে যাও–মহা ঝামেলা।
হঠাৎ একটা কথা মনে এসে বেদম হাসি পেয়ে গেল ইন্দ্রর। আচ্ছা, পিসিমাকে যদি কোন স্টেজে তুলে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়? ভাবতে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে হেসেই ফেললো ইন্দ্র। কথার তোড়ে একেবারে সভা ভাসিয়ে দিতে পারবেন পিসিমা। হ্যাঁ, সে ক্ষমতা তিনি রাখেন। যে কোন সাবজেক্টেই হোক, পিসিমা হারবেন না।
ঠাকুরদা যদি লেখাপড়া শেখাতেন পিসিমাকে তো উনি হয়তো ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারতেন, পারতেন দেশনেত্রী হতে। হয়তো দ্বিতীয় সরোজিনী নাইডু হতে পারতেন। কিন্তু কিছুই হলেন na। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে একটি গৃহগণ্ডীর মধ্যেই নিজেকে ক্ষয় করে ফেললেন।
আমাদের দেশে জীবনের কী অপচয়!
আমাদের সমাজে মানুষ কী মূল্যহীন!
.
বাড়ির মধ্যে কী তুফান উঠেছে, নীহারকণা আর চন্দ্রনাথ কোন্ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, সে খবর নিচের মহলে পৌঁছয়নি। তাই নিত্য নিয়মে সব কাজ মিটিয়ে জগ, দারোয়ান আর ঠাকুর বাইরের দিকে প্যাসেজটার সামনে বসে তাস খেলছিল। ইন্দ্রনাথের ফিরতে রাত প্রায়ই হয়, তার খাবার ঢাকাই থাকে, এলে গরম করে দেওয়া হয়। যদিও এ সমস্ততে ইন্দ্রনাথের আপত্তি–সে বলে, কত লোকের পান্তাভাতই জোটে না, আর একটু ঠাণ্ডা খাবারে এত ইয়ে! কিন্তু তাহলে হয়তো পিসিমা বাড়িসুষ্ঠু সবাইকে না খাইয়ে সারা বাড়ি সজাগ করিয়ে রাখবেন। তার চাইতে এই রফা। খেয়ে নেবে সবাই, শুধু ইন্দ্রনাথ এলে তার আহার্য বস্তু গরম করে দেবে।
ইন্দ্রনাথ গাড়িকে একেবারে গ্যারেজে তুলে রেখে বাড়ি ঢোকে, গাড়ির চাবি নাচাতে নাচাতে মৃদুগুঞ্জনে গান গাইতে গাইতে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
ওকে দেখেই চাকররা উঠে দাঁড়ালো। তাসটা অবশ্য চাপা দেওয়া গেল না। ইন্দ্র এক নজর দেখে হেসে উঠল–কী বাবা, জুয়াটুয়া চালাচ্ছো নাকি? দেখো সাবধান! যা দেখছি, একেবারে ত্রিশক্তি সম্মেলন। একটি বঙ্গজ, একটি বেহারী, একটি উড়িষ্যা নন্দন। তা জুয়া চালাচ্ছিস তো?
কী যে বল খোকাবাবু, জুয়া খেলতে যাবো কেন?
খেলতে যাবি কেন? হাঃ হাঃ হাঃ! সারা পৃথিবীটাই তো জুয়া খেলছে বে! ভগবান যে ভগবান, তিনিও মানুষগুলোকে নিয়ে জুয়া খেলছেন! নাঃ, এসব দার্শনিক ব্যাখ্যা তোদর মাথায় ঢুকবে না। চলহে ঠাকুরচন্দ্র তোমার ডিউটি সারতে! ভীষণ অবস্থা, ঘর বাড়ি ইট পাটকেল খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে!
ঠাকুর এস্তে এগোতে গিয়ে আবার কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে।
আর জগ অপ্রসন্নভাবে তাসগুলো গোছাতে গোছাতে বলে, সঙ্ঘে যে এত ঘটাপটা হয়, তা কেউ কিছু খেতে দেয় না?
খেতে? বলিস কী? সে কি একটা-আধটা লোক? কাকে খাওয়াবে?
আহা রাজ্যিসুন্দুকে কি আর গেলাবে? হচ্ছে তোমার কথা। তুমি হলে গে সেক্রেটারি!–নাও, এখন চটপট সেরে নাও গে। পিসিমা রেগে আছে।
রেগে আছেন? তুই বুঝি বলিসনি আমার দেরি হবে?
জগ গম্ভীরভাবে বলে, বলবো আবার কখন? সেই মেয়েছেলে দুটো চলে যাওয়া ইস্তক পিসিমা কি ঘর থেকে বেরিয়েছে? এই এ্যাতত বড় মুখ করে ঘরের মধ্যে বসে আছে! তারপর বাবুর সঙ্গে কত কথা, কত সলা-পরামর্শ!