চন্দ্রনাথ বোধ করি মরিয়া হয়েই আজ দিদির প্রতিবাদ করে ফেলেন। বলেন, কী যে বলল দিদি! এখন রাগের মাথায় যা নয় তাই বলছো বলেই কি আর
যা নয় তাই মানে? নীহারকণা বজ্রগর্ভ স্বরে বলেন, নীহারকণা কখনো যা নয় তাই বলে না চন্দর। যা হয়, তাই বলে। রেজেস্টারী-মেজেস্টারী নয়, অগ্নি-নারায়ণ সাক্ষী করে স্বজাতির মেয়ের সঙ্গে বামুন-পুরুত ডেকে বিয়ে, এ তো আর রদ হবার নয়? বৌকে গ্রহণ করতেই হবে।…তার ওপর পেটে একটা জন্মেছে!
চন্দ্রনাথ কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, কিন্তু আমি ভাবছি দিদি, এ কখনো সত্যি হতে পারে? এ কাজ ইন্দ্র করতে যাবে কেন?
কেন? নীহারকণা ভয়ংকরী মূর্তিতে বলেন, কেন, তা কি আবার তোকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে চন্দর? বিয়ের বয়েস পার হতে চললো ছেলের, তুই বাপ, এখনো নাকে সর্ষে তেল দিয়ে বসে আছিস। উড়ুক্কু মন নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরে, অসাবধানে ডাকিনীর ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছে। আগে বলিনি তোকে আমি, ছেলের এত পরোপকারে মতিগতি কেন চন্দর? সামলা ওকে!..বাপের পয়সা আছে, নিজে তিন-চারটে পাস করে মোটা মাইনের চাকরি করছিস, হাসবি খেলবি গাইবি বাজাবি, ডানাকাটা পরী খুঁজে এনে বিয়ে দেব, ঘর-সংসার করবি, তা নয়, কোথায় বুড়ো দামড়াদের জন্যে নাইট ইস্কুল করছে, কোথায় যত রাজ্যের কলোনি-মলোনিতে ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াচ্ছে–কে ঘর পাচ্ছে না, কে রোগে ওষুধ পাচ্ছে না, কে জলকষ্টে মরছে। কেন? সুখে থাকতে এ ভূতের কিল খাওয়া কেন বাপু? তা না, বাপ হয়ে তুই তখন দিব্যি গা • এলিয়ে দিলি আহা করছে করুক, সৎকাজ। এখন বোঝ সৎকাজের ঠ্যালা! চিরকেলে কথায় কাছে–ঘি আর আগুন!
চন্দ্রনাথ শেষবারের মত সন্দেহ ব্যক্ত করেন, যতই হোক, এ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না দিদি ইন্দ্র লুকিয়ে বিয়ে করবে! আর সে কথা তোমার কাছে সুষ্ঠু গোপন করে রাখবে।
হঠাৎ প্রবল আলোড়নে এক ঝলক অশ্রু এসে পড়ে নীহারকণার জ্বলন্ত চোখ দুটোয়। এতক্ষণে গলাও ধরে আসে, সেই দুঃখেই গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে করছে রে চন্দর। করলি করলি আমায় কেন জানালি না? হোক গরিব, হোক বিধবার মেয়ে, না হোক তেমন সুন্দরী, তবু আমি তত্ত্বতালাশ করে পানপত্তর পাকাঁদেখা করে তোক জানিয়ে বিয়ে দিতাম। না হয়। আত্মকুটুম্বকে বলতাম, গরিবের মেয়ে উদ্ধার করছি। এ আমাকে ভয় করতে গিয়ে যে আমারই গালে মুখে চুনকালি দিলি!
কত দিন এ কাজ হয়েছে? মরমে মরে গিয়ে বলেন চন্দ্রনাথ।
মাগী তো বললো দুতিন, বছর। ছেলেটাও তো দিব্যি বড়সড়, কোন না বছরখানেকের হবে।
চন্দ্রনাথ নিশ্বাস ফেলে বলেন, কলকাতা শহরে কত ঠগজোচ্চোর আছে। তাই বলছি ছেলেটাকে কি ইন্দ্রর বলে মনে হলো দিদি? মেয়েমানুষের মতই কাপড়ের খুঁটে চোখ মোছেন চন্দ্রনাথ।
অবিকল চন্দর, অবিকল! নীহারকণা রায় দেন, ঠিক ইন্দু ছোটবেলায় যেমনটি ছিল। রোগা রোগা ফরসা ফরসা। ঠিক তেমনি একমাথা চুল।
আর সন্দেহের কী আছে?
চন্দ্রনাথ যেন কথা খুঁজে না পেয়েই অন্যমনস্কভাবে বলেন, মেয়েটা কি খুব সুন্দর?
বললাম তো সবই। রূপ আছে কিন্তু অমন রূপসী কি আমার ইন্দুর জুটতো না?
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।
চন্দ্রনাথ কতক্ষণ ইতস্তত করে বলে ফেলেন, আচ্ছা দিদি, এমনও তো হতে পারে, ঝেকে পড়ে দৈবাৎ একটা দোষঘাট করে ফেলেছিল ইন্দ্র, তাই এরা কায়দায় পেয়ে…মানে আর কি…বিয়েটা হয়তো হয়নি!
নীহারকণা প্রবল বেগে মাথা নাড়েন, ছি ছি, ও কথা বলিসনে চন্দর! এ কথা ভাবলে ইন্দুর ওপর আরও অবিচার করা হবে। ইন্দু যত অকাজই করে থাকুক, এতবড় মহাপাতকীর কাজ কখনো করবে না।…না না, সে ডাকিনীদের চক্রে পড়ে বিয়েই করে বসেছে। তারপর ভয়ে কাঠ হয়ে বাড়িতে বলতে পারেনি।…হুঁড়ির সিঁথেয় ডগড়গ করছে সিঁদুর!
কিন্তু এতদিন কেন তাহলে ওরা নীরব ছিল? চন্দ্রনাথ যেন যুক্তি হাতড়ে বেড়ান।
আহা, বললাম তো সবই। প্রথম প্রথম নাকি ইন্দু আসা-যাওয়া করছিল, তারপর অনেকদিন অবধি মাসোহারাও দিয়েছে, এখন আর খোঁজ-উদ্দিশ করে না। বাচ্চাটাকে নিয়ে ছুঁড়ি এখন উপোস করতে বসেছে। তাই মা মাগী ধরে-করে নিয়ে এসেছে।..হুঁড়ি তো আসতে চায়নি, বলেছিল বুঝি তার এই ফটোখানা বুকে করে ঘরে পড়ে শুকিয়ে মরবো সেও ভাল। কিন্তু ওই যে পেটের শত্রুর! ওর জন্যেই আবার
চন্দ্রনাথ তার ঊষর টাকে হাত বুলোত বুলোতে ঘরে পায়চারি করছিলেন, এখন আবার দিদির কাছে সরে এসে যেন নিজের মনেই বলেন, কিন্তু মাসোহারা বন্ধ করে দেবে ইন্দ্র!..ইন্দ্রর দ্বারা এমন কাজ সম্ভব?…যে ছেলে রাজ্যের দীনদুঃখী গরিব ফকিরকে মাসোহারা দিয়ে বেড়ায়। যতই হোক, যখন বলছো নিজের স্ত্রী-সন্তান!
আহা, বুঝছিস না? নীহারকণা চোখের কোণটা কুঁচকে, ঠোঁট টিপে বলেন, ওই ছুঁড়ি কি আর ইন্দুর যুগ্যি? দয়ার শরীর ওর, গরিব দেখে দয়ায় পড়ে করে ফেলেছে কাজটা। এখন আর ভাল লাগছে না। এখন ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে।…এখন সমযুগ্যি মেয়ে দেখে বিয়ে করতে সাধ হয়েছে নিশ্চয়।
হঠাৎ যেন বিনামেঘে বজ্রপাত হয়।
সুস্থির বসুমতীর বুক থেকে ভূমিকম্প ওঠে। চিরদিনের মিনমিনে চন্দ্রনাথ চিৎকার করে ওঠেন, এত অধর্ম–আমি সইবো না।… তাকে আমি ত্যেজ্যপুত্তুর করবো।…ওকে আমি বাড়ি থেকে বার করে দেব।…আমার যথাসর্বস্ব রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে দেব।…ওই কুলকলঙ্ক ছেলের মুখ আমি আর দেখবো না…।