তা হতে পারে! জগ লাফিয়ে ওঠে, ঠিক বলেছেন। হা হা, তাই সম্ভব।
এতক্ষণে যেন দম নেয় জগ। আর পরক্ষণেই মনে মনে জিভ কাটে, সর্বনাশ! তাই যদি হয়, তাহলে তো জগ মরেছে। মাঝসিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল ওদের জগ। ছি ছি! কে জানে যদি এরপর ওনাদের সঙ্গেই কুটুম্বিতে হয়! জগ তার এই কেলে মুখখানা তাহলে লুকোবে কোথায়?
.
ইন্দ্রনাথ স্নান সেরে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন হয়ে চায়ের টেবিলে বসে বলে, বাবা এখনো ফেরেননি রে জগ?
না। বাবু যে আজ বলে গেছেন শিবপুর যাবেন, দেরি হবে।
তাই নাকি! তা পিসিমার সেই গঙ্গাজল না গোলাপফুল চলে গেল, না এখনো বসে আছে দেখগে দিকি।
বসে আছে, এই তো দেখে এলাম ঘরে পর্দা ফেলা।
স্ট্রেঞ্জ! বলে আপন মনের অকারণ আনন্দে গান গাইতে গাইতে খাবারের থালা শেষ করতে থাকে ইন্দ্রনাথ। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না পিসিমার ঘরে কী নাটকের অভিনয় চলছে।
খেয়েদেয়ে গুন গুন করতে করতে বেরিয়ে গেল সে, যথারীতি যথাবিধি।
.
দিদি, কী বলছো তুমি? চন্দ্রনাথ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন।
নীহারকণা ভাইয়ের এই বিপর্যস্ত ভাব দেখে ব্যস্ত হলেন। এ অন্য ব্যাপার নয় যে মুখঝামটা দিয়ে বলবেন, মেয়েলিপনা করিসনে চন্দর। ব্যাটাছেলে, তবু দশহাত কাপড়ে কাছা নেই!
কিন্তু এ একেবারে ধারণাতীত ব্যাপার।
নীহারকণা নিজেই কি কম বিপর্যস্ত হয়েছিলেন? যারা এই বিপর্যয়ের কারণ, একবার তাদের দোয়ান দিয়ে বার করে দিতে চেয়েছেন, তখুনি তাদের মিনতি করেছেন গোলমাল না করতে। একবার বলেছেন, তোমাদের মত মেয়েমানুষ ঢের দেখা আছে আমার। এখানে জোচ্চুরি করে পার পাবে না, হাতে দড়ি দিয়ে ছাড়বো। আবার তখুনি তার আঁচলে জোর করে নোটের গোছা বেঁধে দিয়েছেন মিষ্টি খেও বলে।
প্রত্যয় আর অপ্রত্যয়ের যুগল রঞ্জুর দোলায় দুলতে দুলতে শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত হৃদয়ে প্রত্যয়ের দড়িটাকেই মুঠিয়ে ধরেছেন নীহারকণা।
এখন চিন্তা,…অতঃপর কী? মাথা খুঁড়ে মরতে পারলেই বুঝি সবচেয়ে ভাল হতো তাঁর।
ছি ছি ছি! যা কল্পনার অতীত, ধারণার অতীত, বিশ্বাসের অতীত, তাই সংঘটিত হয়েছে তারই বড় আদরের, বড় স্নেহের, বড় বিশ্বাসের ইন্দুকে দিয়ে!
ওই সরলতার ছদ্মবেশী আধারে এত গরল!
নীহারকণার হৃদয়কক্ষে তাঁর ইষ্টদেবতা বালগোপালের মূর্তিরও উপরে যার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত, নিষ্পাপ নির্মল দেবমূর্তির মতই যে মূর্তিখানি, সেই মূর্তির মধ্যে লুকোনো আছে–এই শয়তান বদমাইশ! ফুলের মধ্যে সাপ!
ইন্দ্র মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছে, কি ভয়ানক একটা কুকর্ম করে ফেলেছে বলে যতটা মর্মাহত হয়েছেন নীহারকণা, তার চাইতে শতগুণ মর্মাহত হয়েছেন এই দেখে যে, সেই পাপ সে এই দীর্ঘকাল ধরে নীহারকণার কাছে পর্যন্ত গোপন করে এসেছে।
যতবার ভাবছেন ইন্দু তাকে ঠকিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ঠকিয়ে আসছে, ততই বুকটা ফেটে যাচ্ছে নীহারকণার। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, নিজের চুলগুলো মুঠিয়ে ধরে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে সেই মহাপাতকী আসামীটাকে দুহাতে ধরে সজোরে নাড়া দিয়ে দিয়ে বিষ তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করতে–ওরে তোর মনে এত ছলনা? তোর মনে এত কালকূট? বংশের মুখে চুনকালি লেপে, বাপ-পিসির গালে চড় মেরে এই কীর্তিটা করে দিব্যি বুক বাজিয়ে আহ্বাদে গোপাল সেজে মায়া কাড়িয়ে বেড়াচ্ছিস? ওরে হতভাগা, এতটা বুকের পাটা তুই পেলি কোথায়?
কিন্তু আপাতত সেই পাপিষ্ঠকে হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবু নাকি চাকরবাকরদের বলে গেছে ফিরতে দেরি হবে ক্লাবে ফাংশন আছে। কখনো তা নয়, নীহারকণা মনে মনে যেন বাতাসের উদ্দেশেই কটুক্তি করেন,..ফাংশন না হাতী! বুঝি না কিছু আমি? নিশ্চয় টের পেয়েছিস তুই হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে। তাই মনে করেছিস–যত দেরি করে ফিরতে পারি, কেমন? কিন্তু সে আশা ছাড় তুমি। সমস্ত রাতও যদি বাড়ি না ফেরো, তোমার এই দজ্জাল পিসিটি সমস্ত রাত জেগে বসে পাহারা দেবে। হেস্তনেস্ত তো করতেই হবে একটা।
যাক, আপাতত সে না থাকুক তার বাপ আছে।
চন্দ্রনাথ ভয়ে ভয়ে বলেন, দিদি, আমার মনে হয় এসব কোন ষড়যন্ত্র। ইন্দ্র এলে তাকে জিগ্যেস করে—
নীহারকণা গম্ভীরভাবে বলেন, ইন্দ্র এলে তাকে জিগ্যেস করতে হবে, এ কথা আর তুই আমাকে শেখাতে আসিসনে চন্দর। জিগ্যেস করা কাকে বলে, জেরা করা কাকে বলে, সে আমি বাছাধনকে বুঝিয়ে ছাড়বো। তবে অবিশ্বাসের আর কিছু নেই। গোড়ায় আমিও ভেবেছিলাম ষড়যন্ত্র। তাদের গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মেয়েটা যখন ইন্দু হতভাগার ফটোখানা বার করে দেখাল, তখন আর অবিশ্বাসের রইল কী! মাথা হেঁট হয়ে গেল আমার। আদর করে তার সঙ্গে আবার নিজের ফটো তোলা হয়েছে। কিন্তু ভাবছি, আজকালকার ছেলেপুলে কী সর্বনেশে চীজ! এদের যে চিনতে পারবে, সে এখনো তার মাতৃগর্ভে আছে। কচি ছেলেটার মতন হাবভাব তোর, এখনো পিসি বলে কোল ঘেঁষে বসিস, আর তুই কিনা তলে তলে এই কীর্তি করেছিস!…বিয়ে করেছিস, ছেলের বাপ হয়েছিস, এতগুলো দিন সেসব কথা লুকিয়ে রেখেছিস! ওরে বাবারে!… ভাবছি আর বিষ খেয়ে মরতে ইচ্ছে করছে আমার!
চন্দ্রনাথ ভয়ে ভয়ে বলেন, দিদি, চাকর-বাকররা শুনতে পাবে।
তারা শুনতে পাক, এ বাসনা অবশ্য নীহারকণারও নেই, তবু জেদের সুরে বলেন, পাক না। এরপর যে জগৎ শুনবে। কার শুনতে বাকি থাকবে? ওই বৌ নাতিকে মাথায় করে নিয়ে এসে বরণ করে ঘরে তুলতে হবে না?