এদের ভাবভঙ্গিতে কী যেন একটা ভয়ংকরতার আভাস। তাই সহসা সবলে নিতান্ত কঠোর হয়ে উঠলেন নীহারকণা। রূঢ় স্বরে বললেন, ইন্দু পিসিকে মা বলে, কি খুড়োকে মেসো বলে, সে কথা তোমার কানে ধরে কে বলতে গেছে বল তো বাছা?
মেয়েটি ফের মাথা নিচু করল। গালের উপর গড়িয়ে পড়ল দুটি মুক্তার ধারা।
বিধবা ভদ্রমহিলাটিও এবার একটু কঠিন হলেন। কঠিন না তোক দৃঢ়। বললেন, কে বলতে গেছে, সেইটুকু বলতেই তো আসা দিদি। বলতেই হবে আমাকে। নইলে শুধু শুধু আপনাকে জ্বালাতন করতে আসবো কেন? কিন্তু সে কথা তো এই সদরে দাঁড়িয়েই বলবার নয়।
নীহারকণা রুক্ষভাবে বলেন, সদরের লোক সদরে দাঁড়িয়েই কথা কওয়ার রীত, খামোকা অন্দরেই বা নিয়ে যাবো কেন তোমাদের?
মহিলাটি বোধ করি এবার বিচলিত হলেন। বিচলিত স্বরেই বললেন, খামোকা অকারণ সে আবদার আমি করবোই বা কেন বলুন? নেহাৎ নিরুপায় বলেই এই মেয়ে নাতি নিয়ে ছুটে এসেছি। তবে দরকার শুধু একা আমারই নয়, আপনাদেরও। তাই বলছি–মাথা ঠাণ্ডা করে সব শুনতেই হবে আপনাকে।
শুনতেই হবে। তবে আর কথা কি আছে! নীহারকণা বলেন, শুনতেই যখন হবে, তখন এসো আমার ঘরে। কিন্তু তোমাদের মতলব আমি বুঝতে পারছিনে বাপু। ঘরের দিকে এগিয়ে যান নীহারকণা।
মহিলাটিও পিছু ধরে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ করে বলেন, আয়।
আমি এখানেই থাকি না মা! মেয়েটির কণ্ঠে অসহায় মিনতি।
ওখানে আবার একা দাঁড়িয়ে থাকবি কোথা? চারদিকে চাকর-বাকর ঘুরছে–চলে আয়!
মার্জিত খোলসের ভিতর থেকে যেন চকিতে একটা অমার্জিত স্থূলতা উঁকি মারে। নীহারকণা নীরস ভাবে বলেন, থাকতে ইচ্ছে হয় থাকো, আসতে ইচ্ছে হয় এসো। আমার বাড়ির চাকর বাকর এমন জানোয়ার নয় যে, তোমাকে একলা দেখলেই অমনি গিলে ফেলবে!
চাকর-বাকর তেমন নয়? মহিলাটির মুখে একটি সুক্ষ্ম ব্যঙ্গ হাসি ফুটে ওঠে,–তবু ভাল!
নীহারকণার চোখ এড়ায় না এ হাসি, তিনি বিরক্ত ভাবে বললেন, হাসবার কী হলো বাছা! তোমার তো কথার ধরন-ধারণ ভাল নয়!
মহিলাটি কিন্তু দমেন না, তেমনি ব্যঙ্গের ভঙ্গিতেই বলেন, ভাল ভাল কথা আর শিখবো কোথা থেকে বলুন? আর শিখতে পারলেই বা গরিবের মুখে সেকথা মানাবে কেন? ভাল ঘরের মানুষরাই গরিব মজাবার জন্যে ভাল ভাল কথার চাষ করে থাকেন। আর সেই কথার ফাঁদে পড়ে গরিবকে আবার সেই আপনাদের দরজাতেই ছুটে আসতে হয়!
চিরনির্ভীক নীহারকণা সহসা যেন ভয় পান। এ কোন ধরনের কথা? কে এই মেয়েমানুষটা? কিসের সাহসে ওর মুখে ওই ব্যঙ্গের হাসি? আর নীহারকণাই বা সাহস পাচ্ছেন না কেন ওই ধৃষ্ট মেয়েমানুষটাকে দারোয়ান দিয়ে দূর করে দিতে? কোন্ অদৃশ্যলোক থেকে–কে নিয়ন্ত্রণ করেছে নীহারকণাকে?
নীহারকণা ভয় পেয়েছেন, তবু স্বভাবগত বাচনভঙ্গি ঠিকই বজায় রয়েছে। ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন তিনি, হেঁয়ালি থাক বাছা, যা বলতে চাও বলে ফেল চটপট।
চটপট বলে ফেলবার কথা হলে তো বলেই ফেলতাম, কিন্তু তা নয় বলেই আপনাকে কষ্ট দেওয়া।…একটু অন্তরালে যেতে হবে।
অন্তরালে! নীহারকণার বুকটা কেঁপে ওঠে। আশ্চর্য!…এমন করে ভয় পেয়ে বসলো কেন। তাঁকে? তবু তিনি মুখে সাহস দেখিয়ে ফের ভুরু কোঁচকালেন,–অন্তরালে মানে?
মানে বলেছিই তো, দরদালানে দাঁড়িয়ে বলবার মত কথা নয়, তাই।
নীহারকণা বলতে পারলেন না, তবে যাও বিদেয় হও। প্রথমেই এসে ইন্দ্রনাথের নাম করে এরা যেন কাবু করে ফেলেছে তাকে। তাই নীরস স্বরে বললেন, তবে চল ঘরের মধ্যে। এমন অনাছিষ্টি আবদারও শুনিনি কখনো।
.
এঁরা ঘরে ঢোকেন, ছোট ছেলেটার হাত ধরে মেয়েটিও অগত্যাই যেন মার পিছন পিছন ঢোকে।
ঘরে ঢুকে নীহারকণা কী ভেবে একটু ইতস্তত করে দরজার পর্দাটা টেনে দিলেন।
কে জানে কোন্ রহস্য উদঘাটিত হবে সেই পর্দার ওপিঠে!
.
তার মানে? ইন্দ্রনাথ গায়ের ভারী পোশাকগুলো খুলে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে বলে, ভায়া জগবন্ধু, তুমি যে রহস্য হয়ে উঠছ! পিসিমা আবার ঘরে পর্দা টেনে কার সঙ্গে গোপন পরামর্শ করছেন?
জানিনে দাদাবাবু। জগ ছড়ানো পোশাকগুলো কুড়িয়ে জড়ো করতে করতে সন্দিগ্ধভাবে বলে, মনে হচ্ছে কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে।
তোর মনের মধ্যে তো সর্বদাই যত সব ব্যাপার ঘটছে! ইন্দ্রনাথ ধপাস্ করে ডাক্লপের গদি-দেওয়া বিছানাটার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে পা নাচাতে নাচাতে বলে, আপাতত চায়ের ব্যাপারটি ঘটাও দেখি। যতদূর দেখছি, পিসিমাকে এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ঘাত ওঁর সেই সইয়ের মায়ের গঙ্গাজলের বোনপো বোয়ের বকুলফুলটুল এসেছে। একজন বুড়ি, একজন মেয়েমানুষ আর একটা বাচ্চা বললি না?
আজ্ঞে হ্যাঁ, দাদাবাবু।
ব্যস্ ব্যস্, ঠিক আছে। সদাহাস্যময় ইন্দ্রনাথ গুনগুন করে এককলি গান গেয়ে বলে ওঠে, এ আর কেউ নয়, সেই বোনপো বোয়ের কদমফুল আর তার ছেলে-মেয়ে। পিসিমা আজ একেবারে গেলেন! আর কিছু নয়, বুঝলি জগ, নিশ্চয় কিছু বাগাতে এসেছে। নইলে দশ পাঁচ বছর পরে কেউ কখনো খুঁজে খুঁজে পুরনো আলাপীর বাড়ি আসে?
পুরনো আলাপী-টালাপী কিছু না, জগবন্ধু ইন্দ্রনাথের খাটের বাজুগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, পিসিমা সাতজন্মেও চেনে না ওদের। তাছাড়া সাহায্য-টাহায্য চায় না তেনারা।
চেনা নয়! সাহায্য নয়! ইন্দ্রনাথ হেসে উঠে বলে, তবে বোধহয় আমার বিয়ের সম্বন্ধ করতে এসেছে!