হরিবোল হরি, কী বলেন গো পিসিমা! মেয়ের মাথায় যে টকটক করছে সিঁদুর, সঙ্গে একটা এইটুকুনি বাচ্চা। মনে নিচ্ছে, অন্য কোন বিপদে পড়ে এসেছে। আচ্ছা ডাকি-ই না বাপু, হাতে পাঁজি মঙ্গলবারে কাজ কি?
হরেকেষ্ট! এই যে এঁরা উঠেই এসেছেন! ওগগা বাছা এই ইনিই হচ্ছেন বাড়ির গিন্নী, বুঝলেন? ওই যে পিসিমা বলছিলাম না–নান, দেখা করিয়ে দিলাম। জগ আবার জলভরা বালতিটা তুলে নিয়ে দুমদুম করে চলে যায়। আর পিসিমা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন হাঁ করে।
না, এহেন ভদ্রমহিলার আবির্ভাব আশা করেননি তিনি। ভেবেছিলেন আধা-ভিখিরী গোছেরই কেউ হবে। জগর মুখে আপনি শুনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন।
আধা-বয়সী একটি শুভ্র থান পরিহিতা বিধবা, জীর্ণ হলেও পরিচ্ছন্ন একখানি সিল্কের চাদর গায়ে, নিরাভরণ দুখানি হাত জড়সড় করে বুকের কাছে রাখা, মুখের রেখায় রেখায় একটি ক্লান্ত বিষণ্ণতা। তারই পিছনে একটি সুশ্রী সুঠাম তরুণী মেয়ে, নিতান্ত সাদাসিধে সাজ, নিটোল সুগোল মণিবন্ধে একগাছি করে সরু বালা মাত্র। তার মুখের চেহারা আরো বিষণ্ণ, আরো ক্লান্ত, আরো স্তব্ধ। মাথাটা ঈষৎ নিচু করে দাঁড়ানোর দরুনই বোধ করি অপরাহের আলোতে সরু সিঁথির উপর টানা সিঁদুরের রেখাঁটি এত স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ছে। এক হাতে মেয়েটির একখানা হাত শক্ত করে ধরে আর অন্য হাতের আঙুলগুলো মুখের মধ্যে পুরে দাঁড়িয়ে আছে একটি বছর দেড়েকের রোগা গড়নের ফর্সা ছেলে।
পথে পথে ঘুরে কেঁদে পড়ে সাহায্য চেয়ে যারা বেড়ায়, এরা যে সে শ্রেণীর নয়, তা এক নজরেই বোঝা যায়।…কিন্তু তাহলে কি?
তাহলে কেন এই ম্লান বিষণ্ণ স্তব্ধ ভঙ্গি?
.
কে গা বাছা তোমরা? স্বভাববহির্ভূত নরম গলায় বলেন নীহারকণা।
সত্যি, নরম গলায় কথা বলা নীহারকণার প্রায় কুষ্ঠিতেই লেখে না। বড়লোকের মেয়ে, নিতান্ত অল্পবয়সে বিধবা। চিরদিনই কেটে গেল পিত্রালয়ের আরাম-ছায়ায়। আর ষোল আনা দাপট করেই এলেন চিরকাল। স্নেহময় বাপ বিধবা মেয়ের হৃদয়ের শূন্যতা পূর্ণ করতে বরাবর তাঁকে দিয়ে এসেছিলেন সংসারের একাধিপত্য কর্ত্রীত্ব।
এখন বাপ গেছেন, কিন্তু অনুগত ভাই আছেন। বুড়ো হয়ে গেলেন, এখনো চন্দ্রনাথ দিদির কথায় ওঠেন বসেন, দিদির চোখেই জগৎ দেখেন, দিদিকে যমের মত ভয় করেন।
কেন তা জানেন না চন্দ্রনাথ। আশৈশব দেখে আসছেন দিদির ইচ্ছেই সংসারে শেষকথা। দিদিকে মান্য করে চলা ছাড়া অন্য কিছু সম্ভব, একথা চন্দ্রনাথ জানেন না।
বালবিধবা নীহারকণার ভাগ্যটা এ বিষয়ে এমনই জোরালো যে, যে-মানুষটা চন্দ্রনাথের এই দিদিভক্তিতে জ্বলে পুড়ে মরতে, বাড়িসুদ্ধ লোকের নীহারকণার প্রতি এই অকারণ বাধ্যতায় থেকে থেকে বিদ্রোহ করে বসতো, সে বেচারা আস্ত মানুষ হয়ে ওঠবার আগেই মরে গেল। নগরে উঠতে না উঠতেই বাজারে আগুন লাগলো চন্দ্রনাথের। দুবছরের মাতৃহীন ছেলেটাকে নিয়ে আরো বেশি করে দিদির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লেন চন্দ্রনাথ।
যাক, সে অনেক দিনের কথা।
সেই ছেলে এখন বিদ্বান হয়েছে, কৃতী হয়েছে। রাজপুত্রের মত রূপবান স্বাস্থ্যবান ছেলে। তবে তার উপরও সমান দাপট নীহারকণার, কাজেই নরম গলায় কথা নীহারকণা দৈবাৎ কন। আজ কেন কে জানে এদের দেখে নীহারকণার কেমন একটা অস্বস্তি হল, গা-টা কেমন ছমছম করল, ওই বিষণ্ণ দুটি মুখ দেখে কেমন সমীহ হল। বললেন নরম গলাতেই, আমার কাছে কী দরকার তোমাদের বাছা?
বিধবা মহিলাটি স্নান গলায় বলেন, আমি–মানে ইন্দ্রনাথের মা-র সঙ্গে একটু দেখা করতে চাইছিলাম।
ইন্দ্রনাথের মা! নীহারকণা সচকিতে তাকিয়ে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেন, ইন্দ্রনাথ! ইন্দুকে, ইয়ে, ইন্দ্রকে তুমি জানো নাকি?
জানি। মাথাটা আর একবার হেঁট করেন মহিলাটি।
জানো? বলি কেমন ভাবে জানো? কী সুবাদে? নিজস্ব কণ্ঠের প্রশ্ন এবার নীহারকণার।
মহিলাটি যেন অসতর্কে একবার পশ্চাদ্বর্তিণীর দিকে চকিতদৃষ্টি ফেলে বলেন, সে কথা ইন্দ্রনাথের মা-র কাছেই বলতাম।
বটে! নীহারকণার মুখে একটি তিক্ত-কঠিন হাসি ফুটে ওঠে। সেই হাসি হেসে বলেন, তা খুব জরুরী কথা বোধ হয়? তাড়াতাড়ি বলতে হবে?
যত তাড়াতাড়ি হয়! মহিলাটি কম্পিত স্বরে বলেন, ঈশ্বর জানেন যে করে এসেছি!
বেশি তাড়াতাড়ি থাকলে নীহারকণা গম্ভীরকণ্ঠে বলেন, শীগগির কাজ দেয় এরকম খানিকটা বিষ এখুনি খেয়ে ফেলতে হয়, যাতে চটপট তার কাছে পৌঁছে যেতে পার! এ ভিন্ন আর কোন উপায় দেখি না।
হ্যাঁ, নীহারকণার কথার ধরনই এই রকম।
মহিলাটি এই অদ্ভুত কথায় প্রথমটা চমকে গেলেন, তারপর অর্থটা বুঝে ফেলে কালিবর্ণ মুখে বলেন, ওঃ, তিনি নেই বুঝি?
যাক বাছা, তবু বুঝলে! বলি ইন্দ্রনাথকে জানো, আর দুবছর বয়সে তার মা মরেছে–তা। জানো না? তোমাদের রকম-সকম আমি বুঝতে পারছি না বাপু!
এবারে তরুণীটি মুখ তোলে। আর তার সেই অশ্রুছলছল চোখ দেখে নীহারকণা আর একবার একটু থতমত খান।
তরুণীটি মুখ তোলে বটে, কিন্তু কথা কয় নিজের মা-র উদ্দেশেই, মা, উনি পিসিমাকেই মা বলতেন!
হ্যাঁ, তা অবশ্য বলে ইন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে। সাধ করে বলে। নীহারকণাও জানেন। কিন্তু সে কথা চুলোয় যাক,উনি মানে!
মেয়েটার মুখের এই উনি শব্দটা নীহারকণার কানে বিষবাণের মত লাগল।