কিন্তু কিসের মোহ?…রূপের?…রূপ কি আর আগে কখনো দেখেনি ইন্দ্রনাথ? এর থেকে অনেক রূপসী মেয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নীহারকণা কি ভাইপোকে বিয়েয় প্ররোচিত করতে চাননি? তবে…?
ভালবাসা…? তাই কি? সেদিন যখন সেই ভয়ঙ্কর সত্যটা প্রকাশ হয়ে পড়ল, তখন কি সারা মন কেবলমাত্র ঘৃণায় বিষিয়ে ওঠেনি? ভালবাসার বাষ্পও কি ছিল আর তখন?
কমলা যদি শুধু লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকত, অমন করে নিজের জীবনের নিরুপায়তার কথা না বলত, ইন্দ্রনাথ কি তাকে চিরতরে ত্যাগ করে চলে আসত না? ভিতরের ভালবাসা কি তাকে ক্ষমা করতে শেখাত?
তবে?
ভালবাসার সৃষ্টি তখন কি হয়েছিল? হয়তো শুধু একটা আকর্ষণ। রূপের নয়, বুদ্ধির। সরলতার, সরল বুদ্ধির, লাবণ্যের। সেই লাবণ্যবতীর অশ্রুসজল জীবনকাহিনী এনে দিল ভালবাসার জোয়ার। সেটা কি দয়ারই নামান্তর নয়…?
দয়া করুণা–এর থেকে ভালবাসার উদ্ভব হয়, কিন্তু সেটা কি সারা জীবনের সম্বল হতে পারে?
.
এমন করে বুঝি নিজেকে বিশ্লেষণ করে দেখেনি ইন্দ্রনাথ এই কদিন। বাদল তাকে বড্ড ভাবিয়ে গেল।
বাদল বলে গেল, যার অতীতটা তোমার পরিবেশের সঙ্গে আকাশপাতাল তফাত, সে কী করে তোমার কাছে সহজ হতে পারবে, বলতে পার ইন্দ্রদা? তুমি বলছ স্ত্রীরত্ন দুষ্কুলাদপি –শাস্ত্রের বচন, মানলাম। কিন্তু সে কোনকালের কথা জানো? যে কালে স্ত্রীকে কেবলমাত্র স্ত্রীলোক বলে ভাবা হত, নট জীবনসঙ্গিনী, এ সেই কালের কথা! একালে ও শাস্ত্র অচল। একালে রূপ থাক না থাক, কুল-টা দরকার। দরকার বুদ্ধি আর রুচির সমতা!
কিন্তু কমলার কি বুদ্ধি নেই…? কমলার কি রুচি নেই…?
.
দাদা?
চমকে উঠে দরজার দিকে মুখ ফেরালো ইন্দ্রনাথ, দাদা বলে ডাকল কে?
কে এই ছেলেটা? কোথায় যেন ওকে দেখেছে না ইন্দ্রনাথ? চকিতের জন্যে একবার যেন…
দাদা, সাহসে ভর করে আপনার কাছে এলাম।
কিন্তু আমি তো আপনাকে–
আপনি নয়, আপনি নয়–তুমি। আমাকে আপনি চিনবেন না দাদা, চেনবার যোগ্য মানুষও আমি নই, একজন এসেছে সঙ্গে তাকে আপনি চেনেন।
কে? চমকে ওঠে ইন্দ্রনাথ।
এই যে! এসো কমলা, দাদার সামনে এসে দাঁড়ানো, এইটাই হোক তোমার সমস্ত অপরাধের শাস্তি।
দাদা…আপনার অক্ষম ছোট বোনটাকে ক্ষমা করুন। অস্ফুটে কথাটা উচ্চারণ করে মাথাটা ইন্দ্রনাথের পায়ে লুটিয়ে দিয়ে সে আর সেই লুটোনো মাথাটা কিছুতেই তুলতে পারে না।
ইন্দ্রনাথ, ধীরে ধীরে তার সেই নত মাথার উপর আলতো একটু হাতের স্পর্শ রেখে বলে, থাক থাক, ওঠো।
কমলা ওঠে, কিন্তু মুখ তোলে না।
কিছুক্ষণ নিঝুম নীরবতা।
.
ইন্দ্ৰনাথ শান্ত স্বরে বলে, তোমারই নাম বোধ হয় ননী, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ননী মাথা চুলকে বলে নামটা জানেন দেখছি।
তা জানতাম। খুশী হলাম তোমাকে দেখে …ওঠো কমলা..বুঝতে পারছি–এই ঠিক হল।
দাদা!
থাক কমলা, বেশি চেষ্টায় দরকার নেই…আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। সত্যিই খুসী হচ্ছি তোমাদের দেখে।
বাচাল আর বকাটে ননী বলে ওঠে, দেখলে তো কমলা, বলেছিলে না বরং মরা সহজ তো ওঁকে মুখ দেখানো সহজ নয়!…পেলে না ক্ষমা? আমি বললাম দাদা-দেবতার কাছে আবার দাঁড়াতে পারা না পারার কথা কী? সব আমিত্ব ছেড়ে গিয়ে পায়ে পড়লেই হলো।
ইন্দ্রনাথ তাকিয়ে দেখল ওই নির্বোধ শ্যামলা মুখের উজ্জ্বল স্বর্ণাভা, দেখল ওই গোলগাল মাথা খাটো ছেলেটার পাশাপাশি কমলার বেতগাছের মত ঋজু একহারা দীর্ঘ সতেজ দেহখানি।
দেখতে দেখতে অদ্ভুত একটা কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল ইন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণধীমণ্ডিত মুখে।
.
কী লজ্জা! কী লজ্জা!
কী হাস্যকর পাগলামিতেই পেয়েছিল ইন্দ্রনাথকে! ওর সঙ্গে প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা!
মৃদু হাসি হেসে বলে, কিন্তু অপরাধটা কার, শাস্তি দেবার মালিক বা কে–কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
আপনি আর বুঝতে পারছেন না দাদা? ননী পরম সপ্রতিভভাবে বলে, তবে কিনা আপনি মহিমময়, তাই
বাঃ তুমি তো বেশ ভাল বাংলা জানো দেখছি। কিন্তু আমার ক্ষমার কি সত্যিই দরকার আছে তোমাদের? হয়তো প্রশ্নটা কমলাকেই, ননী উপলক্ষ।
তবু উত্তরটা ননী ই দেয়–আছে বৈকি দাদা, আপনার আশীর্বাদ, আপনার ক্ষমা, এই সম্বল করেই তো আমাদের জীবনযাত্রার শুরু হবে।
হুঁ। আর একবার কৌতুকের হাসি হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ, এত ভাল ভাল কথা জানো, আর উপার্জনের জন্য মানুষ জাল করা ছাড়া আর কিছু ভাল মাথায় আসেনি কেন?
এই কান মলছি দাদা, আর কখনো ওদিকেও যাব না।
কিন্তু একটা ব্যাপারে ভারী খটকা লাগছে আমার কমলা! কমলার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বলে ইন্দ্রনাথ, জাল অরুণাকে ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তোমার এই ননীদার উৎসাহই প্রবল দেখেছিলাম না?…গাড়িতে তো সেদিন…
কমলাও এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর মৃদুস্বরে বলে, বুদ্ধিহীনেরা ওই রকম কাজই করে দাদা, মনের যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে
.
আরও একবার মনে হল ইন্দ্রনাথের কী লজ্জা, কী লজ্জা! এর সঙ্গে প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা!
আর কমলা…? জীবনসঙ্গী হিসেবে ওকেই উপযুক্ত বলে বেছে নিল তাহলে?
বাদলের কথাই তবে ঠিক। পরিবেশের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়।
যাক, ঈশ্বর রক্ষা করেছেন ইন্দ্রনাথকে। কোথা থেকে যেন কী এক মুক্তির হাওয়া এসে গায়ে লাগে। বারবার মনে বাজতে থাকে–এই ভাল হল এই ভাল হল!
কিন্তু কমলার ওই চোখদুটো?