তখন?
কমলা শান্ত বরফ-জমানো গলায় বলে, তখন বুঝবেন তিনি দীঘি ভেবে ডোবার জল খেয়ে আসছিলেন!
তিনি তাই ভাববেন, এটা তুই সহ্য করতে পারবি?
কী করব? একটা কিছু তো করতেই হবে?
কিন্তু কমলি, ঝোঁকের মাথায় এতবড় একটা সৌভাগ্য ঠেলে ফেলে দিয়ে শেষকালে আপসোস করে মরতে হবে!
না–ননীদা আপসোস আমি করব না। করব না বলেই এই কদিন ধরে চব্বিশ ঘণ্টা শুধু ভেবেছি আর ভেবেছি। প্রিয়লতা বলত–ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাবি তুই। তবু নিজেকে সবরকম অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখেছি, দেখে দেখে তবে না বুঝেছি ইন্দ্রের জন্যে দরকার শচীদেবীর। বিধাতাপুরুষ মানুষকে পাঠাবার আগেই রাজার জন্যে রানী আর ঘেসেড়ার জন্যে ঘেসেড়ানী ঠিক করে রাখেন। তোমার মতন বাউণ্ডুলের জন্যে এই বাউণ্ডুলীকে তৈরি করেছেন।
কমলি! তবু ভাল করে ভেবে দেখ।
দেখেছি–ননীদা দেখেছি।
আমি বলছি ইন্দ্রবাবু তোকে শুধু দয়াই করছে না, ভালবেসেও মরেছে।
কমলা ঘাড় ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, এই কথাটাই খাঁটি বলেছ ননীদা, ভালবেসে মরেছে! কিন্তু ওঁকে মরতে দিলে তো চলবে না, অতবড় অপরাধের বোঝা বয়ে বেড়াতে পারব না। ওঁকে বাঁচাব এই পণ নিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়েছি।
কিন্তু এত ক্ষমতা তুই পেলি কোথায় কমলি? অভিভূত ভাবে বলে ননী।
কমলা বিষণ্ণ হাসি হেসে বলে, মুখ মানুষ, মনের কথা ভাল করে বোঝাতে জানি না, তবু বলি ননীদা, অনেকখানি পেলেই বুঝি অনেকখানি ছাড়া যায়। বাকী জীবনটা সুখে দুঃখে যেমন করেই কাটুক মনের মধ্যে এই আলোর আঁচড়টুকু জ্বলজ্বল করবে চিরকালের মতন, সেই আমার মস্ত ঐশ্বর্য।
আমার সারামাসের রোজগারের চাইতে বেশি টাকায় ইন্দ্রবাবু তোকে একটা পাউডার এনে দিত কমলি! নিঃশ্বাস ফেলে ননী।
কমলা মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, আর সেই পাউডার মাখতে মাখতে আমার মনে পড়ত ননীদার সারা মাসের রোজগার এই কৌটোটার দামের চাইতে কম!
তখন আমাকে তোর মনেই থাকত না।
মেয়েমানুষকে তোমরা তাই ভাব ননীদা, কেমন? নিষ্ঠুর অকৃতজ্ঞ হৃদয়হীন বলে–তাই না? কিন্তু এই তোমায় বলছি ননীদা, মেয়েমানুষ যদি রানীর সিংহাসনেও বসে, সে ভুলতে পারে না তার ছেলেকে, ভুলতে পারে না তার প্রথম ভালবাসার লোককে।
.
ইন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরেছে। বাড়িতেই খায়দায়। কিন্তু সঙ্রে অফিসেই কাটছে তার বেশির ভাগ সময়। সম্প্রসারণ চলছে একটা অবৈতনিক স্কুলের।
ওদিকে নীহারকণা স্যাকরা, বেনারসীওলা, হালুইকর, ডেকরেটার, বাড়তি ঝি চাকর ইত্যাদির সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন, আর ইন্দ্রনাথকে হাতের কাছে পেলেই একহাত নিচ্ছেন।
হয়তো বাড়ির ওই সমারোহটা ভারি অস্বস্তিকর লাগছে ইন্দ্রনাথের, তাই ঠিক এই সময় এই ছুতোটা করেছে। স্কুলের বৃদ্ধি আর কটা দিন পরে করলেও চলত।
কিন্তু সঙ্ঘে বুঝি আর সে সম্ভ্রম নেই ইন্দ্রনাথের। সকলেই বাঁকাচোখে তাকাচ্ছে, আর কৌতুকছলে বাঁকা বাঁকা কথা বলছে।
আশপাশ থেকে এমন কথাও কানে আসছে,যারা ডুবে ডুবে জল খায় তারা ভাবে শিবের বাবাও টের পাচ্ছে না, কিন্তু টের সবাই পায়। এতদিন ধরে সবাই সব টের পেয়ে এসেছে।
অর্থাৎ চরিত্রগত দুর্বলতা ইন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল, সকলেই তলে তলে জানতও। এবার নিশ্চয়ই নিতান্ত বেসামাল অবস্থায় পড়ে গেছেন চালাকঠাকুর, তাই এই বিয়ের ব্যবস্থা। তাই এত লোক-জানাজানি।
.
বাদল ওদের দলে নয়।
বাদল ইন্দ্রনাথকে বড্ড বেশি ভালবাসে, তাই যখন তখন কড়া কথা বলছে। আজ এইমাত্র অনেক ঝগড়া করে গেল, অনেক যাচ্ছেতাই করে গেল। বললে, সঙ্ঘের এবার বারোটা বাজল ইন্দ্রদা, সঙ্রে মেরুদণ্ডে ঘুণ ধরেছে!
ইন্দ্র হেসে বললে, এর উল্টোও তো হতে পারে? মেরুদণ্ডে অন্য শক্তির সঞ্চয় হয়ে আরও ভালও হতে পারে?
না, পারে না। বাদল ক্রুদ্ধ হয়ে বললে, যা হতে পারে না, তার কল্পনায় সুখ থাকতে পারে, ফসল ওঠে না। তুমি এখন একটা ভাবের ঝেকে আছ ইন্দ্রদা, তাই বুঝতে পারছ না তোমার এটা দয়া নয়, মোহ।…নির্জলা দয়া হলে মোটা খরচপত্র করে মেয়েটার একটা ভাল বিয়ে দিতে পারতে তুমি, তার জন্যে তাকে বিয়ে করবার দরকার হত না। পৃথিবীতে দুঃখী অসহায় মেয়ের সংখ্যা একটা নয়, কজনকে বিয়ে করবে তুমি?
ইন্দ্রনাথ ওর রাগ আর যুক্তি দেখে হেসে ফেলে বলেছিল, দয়া এ কথাই বা ভাবিস কেন? দয়া ছাড়া আরও তো কিছু হতে পারে!
না, পারে না। তীব্র প্রতিবাদ করে উঠেছিল বাদল, ভালবাসা হয় সমানে সমানে। অসমান ভালবাসা শেষ পর্যন্ত টেকে না, তাকে টিকিয়ে রাখবার চেষ্টা করতে করতে জীবন বিকিয়ে যায়। এই মোহ ভাঙলে সে কথা টের পাবে।
অসমানকে কি সমান করে নেওয়া যায় না বাদল?
না, যায় না। যাকে নিলে বা নিয়েছ বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করলে, শেষ পর্যন্ত সে-ই হয়ে ওঠে একটা বিরুদ্ধ শক্তি। এতটা পাওয়া বহন করতে যে শক্তি থাকা দরকার, সে শক্তি কজনের থাকে?
তুই এত কথা জানলি কোথা থেকে বাদল?
পৃথিবীতে চোখ কান খুলে চরে বেড়ালেই বোঝা যায় ইন্দ্রদা! তোমাদের কি জানো, রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছ, চিরটা দিন ভাবের ঘোরেই কাটিয়ে দিলে! জগৎকে দেখতে এসেছ পরোপকারীর উচ্চাসন থেকে, তাকে জানবার সুযোগই পাওনি, আমাদের তো তা নয়!
.
আরও কত কথা বলে গেল বাদল।
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ইন্দ্রনাথ। মনের গভীরে তলিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে বাদলের কথাই কি সত্যি?..শুধুই মোহ?