কী বলতে?…কমলা অদ্ভুত একটা হাসির সুরে বলে, বলছি। ননীদা,–আমায় নিয়ে পালাতে পারো?
তোকে নিয়ে পালাতে! যন্ত্রের মত উচ্চারণ করে ননী।
হ্যাঁ ননীদা। অনেক অনেক দূরে! আমার বড় বিপদ!
কেন বল্ তো? ননী উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, বিপদ কিসের? তবে কি যা শুনেছি তা ভুল? ওরা কি তোকে পুলিসে দিতে চায়?
পুলিসে?–না ননীদা, তার চাইতেও অনেক বেশি। কমলা ননীর দিকে চোখ তুলে তাকায়।
তার চাইতেও বেশি!–আবার যন্ত্রের মত উচ্চারণ করে ননী।
হ্যাঁ তার চাইতেও বেশি, তার চাইতেও ভয়ের।
ব্যাপার কী?…হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে ননী,..কী, করতে চায় কী?…লোক লাগিয়ে খুন করতে চায়?
লোক লাগিয়ে নয় ননীদা, নিজেই। কমলা কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে বলে, তোমার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। তোমার শোনার ভুল হয়নি। তোমাদের লেকচারবাবু সত্যি সত্যিই আমাকে বিয়ে করতে চায়। তুমি আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার কর ননীদা, আমাকে নিয়ে পালাও।
ননী ধীরে ধীরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তুই কি বাড়ি বয়ে আমাকে ঠাট্টা করতে এলি কমলা?
ঠাট্টা নয় ননীদা, বিশ্বাস কর। যে যার যুগ্যি নয়, তাকে তা দিতে গেলে সেটা বিপদ ছাড়া আর কী? তোমায় যদি কেউ রাজা করে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে চায়, সেটাকে তোমার কী মনে হবে-বিপদ না সম্পদ?
পালিয়ে তোকে নিয়ে গিয়ে আমি রাখব কোথায়? ননী হঠাৎ নিজস্ব ভঙ্গিতে খিঁচিয়ে উঠে বলে, এখানে তো তবু এই খেলাঘরের মত একটু ঘর আছে, আর কোথাও পালিয়ে গেলে এটুকুই বা জুটবে কী করে?
কমলা আস্তে একখানা হাত ননীর হাতের ওপর রাখে। মৃদু রহস্যময় একটা হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে,-নতুন খেলাঘর আমরা বাঁধব, ননীদা।
কমলা! ননী ওর ধরা-হাতটা একবার চেপে ধরেই হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে তীব্র স্বরে বলে ওঃ দয়া! দয়া করতে এসেছিস?
না, ধরা দিতে এসেছি। কমলা মিষ্টি একটু হাসে, নিজের মনের কাছে ধরা পড়ে গেছি আজ।
.
কাঠ ঘুঁটের ঘর থেকে ওরা বেরিয়ে এসেছে। এসে বসেছে পার্কের একটা বেঞ্চে।
অনেক কথা বলবার ছিল কমলার, সব কথা বলা যায় না সেই খুবরিতে বসে, কে কী ভাবছের-উৎকণ্ঠা নিয়ে। ভাগ্যিস এই পার্কগুলো আছে পৃথিবীতে, আছে পার্কে বেঞ্চ পাতার প্রথা, পুষ্পধনুর একটা আসন হয়েছে। পৃথিবীতে যদি পার্কের বেঞ্চ না থাকত, এত প্রেমই কি জন্মাতো?
তা প্রেমের সেই পীঠস্থানেই এসে বসেছে ওরাননী আর কমলা।
কমলা এতক্ষণ ধরে বলেছে তার এই কদিনের চিন্তা আর ঘটনা। বলেছে কেমন করে হঠাৎ তার সমস্ত ভয়ের বন্ধন খুলে গেল, কেমন করে কেষ্টমোহিনীর নাকের সামনে দিয়ে চলে এল একবস্ত্রে শুধু ননীর দেওয়া কয়েকটা বই হাতে করে। কেমন করে আশ্রয় পেল সহকর্মিণী প্রিয়তার কাছে।
বুঝলে ননীদা, হঠাৎ যেন চোখ থেকে কী একটা কুয়াশার পর্দা সরে গেল! কমলা বলে, মনে হল এত ভয় কেন করি আমি? কেন করব?…ভয় দেখিয়ে একজন আমাকে দিয়ে যত ইচ্ছে মন্দ কাজ করিয়ে নেবে কেন? পালিয়ে গেলে রুখছে কে?…পালাতে চাইলে মাসি কি আমাকে আটকাতে পারত?…কখনো না। আমার সে খেয়ালই আসেনি। পরদা-ঢাকা চোখে ঘোরে পড়েছিলাম যে। হঠাৎ দেখলাম কিসের বন্ধনে বন্দী আমি।…একমুঠো ভাত আর একটা আশ্রয়, এই তো! এতবড় পৃথিবীতে জুটবে না তা? সৎ থাকব এই চেষ্টার বিনিময়ে পাব না সেটুকু? সত্যিই কি পৃথিবী এত নিষ্ঠুর? তুমিও এই ভুলই করেছিলে ননীদা। এত পরামর্শ দিতে পেরেছিলে আমায়, এত খেটেছিলে আমার জন্যে, তবু সাহস করে বলতে পারনি, চল কমলি আমরা পালাই। কিছু না পারি দুজনে কুলি খেটেও দুটো পেটের ভাত জুটিয়ে নিতে পারব!
আসল কথা, চট করে কুলিগিরির পথে নামতে আমরা পারি না, তাই আমাদের প্রতি পদে বন্ধন, প্রতি কাজে ভয়! ভদ্র পোশাকের মধ্যে নিজেকে ঢেকে যতদূর নয় ততদূর অভদ্রতা করব, যত রকম দুর্নীতি আছে তাতে স্বীকার পাব, স্বীকার পাব না শুধু সেই ভদ্রলোকের পোশাকটা ছাড়বার! এতদিন ধরে এত ছোটমি করতে হত না ননীদা যদি এ বুদ্ধি আমার আগে আসত, যদি এ বুদ্ধি তোমার থাকত! যাক তবু এই ভাল যে এখনও এল। প্রিয়লতার বাসায় আশ্রয় পেলাম। কত সমাদরে রাখল, বলল না তুই নীচ নোংরা-বলল তুই প্রণম্য। ও আবার একটু কবি কবি তো! দেখতে অবিশ্যি একেবারে বিপরীত! হেসে ওঠে কমলা।
.
ননী মাথা হেঁট করে বসে সব শুনল।
কমলার আক্ষেপ, কমলার উপদেশ। শুনল ইন্দ্রনাথ কিভাবে প্রিয়লতার মাধ্যমে কমলাকে ভাবী স্ত্রীর উপযুক্ত যৌতুক পাঠাচ্ছে। অর্থাৎ কিছুতেই যেন কমলা আর এতটুকু কষ্ট না পায়। বিয়ের ঘাঁটিও হবে ওই প্রিয়লতার বাড়ি। যদিও সে দুঃখী, কিন্তু বাড়িটা ভাল। বাড়িটা তার বাবার আমলের। দাদারা পৃথক হয়ে রয়েছে পার্টিশন দেওয়াল না তুলেই; প্রিয়লতা মাকে নিয়ে একাংশে আছে। অল্প বয়সে বিধবা নিঃসন্তান প্রিয়লতার মা ছাড়া আর গতি কোথা?
কিন্তু বেশি বয়সে বিধবা, সন্তান সমাকুলা প্রিয়লতার মায়ের-ই বা মেয়ে ছাড়া গতি হল কই?
এ যুগের এ ধর্ম বলেছে প্রিয়লতা। ছেলেরা আর বিধবা মায়ের দায়িত্ব নিতে রাজী নয়, তাদের যুগলজীবনে মা বস্তুটা একেবারে অবান্তর। অতএব মেয়েরাই নিচ্ছে কাছে টেনে।
নিচ্ছে, বেশ করছে, উত্তম করছে, তারাও তো সন্তান। এখন রাখ তোর প্রিয়তার কথা। আমি শুধু ভাবছি কমলি ইন্দ্রনাথবাবুর কথা। তিনি যখন টের পাবেন তুই পালিয়েছিস–