কী ননীদা, বাক্যি হরে গেল নাকি? কমলা!
হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? চিমটি কেটে দেখবে?
চিমটির দরকার নেই, তবে বিশ্বাস করতে একটু দেরি হচ্ছে। তুমি এখানে! এ সময়ে!
হ্যাঁ আমি, এ সময়ে। দরকার পড়লে কি আর সময় অসময়ের জ্ঞান থাকে ননীদা? সব বলছি, কিন্তু আগে আলো জ্বালো।
আলো? কী হবে? কে জানে কোথায় বাতি কোথায় দেশলাই!
কী আশ্চর্য। সে কী কথা? ঘরে একটা আলোর ব্যবস্থা নেই?
না। দরকারই বা কী? তুমি তো আমার ডার্করুমই দেখতে চেয়েছিলে!
কিন্তু আজ আর তা চাইছি না ননীদা, আজ আলোর দরকার, ভয়ানক দরকার।
ননী হাতড়ে হাতড়ে একটা দেশলাই খুঁজে জানলার নিচে পড়ে থাকা একটা আধ-ক্ষওয়া বাতি জোগাড় করে জ্বেলে বলে, তুমি এলে কী করে তাই বল?
এলাম।…চলে এলাম।
তুমি কি এ বাড়ি চিনতে?
নাই বা চিনলাম, ইচ্ছে থাকলে আর চেষ্টা থাকলে ঠিকানা একটা খুঁজে বার করা এমন কিছুই নয়।
কিন্তু দিদি?
দিদি!
হ্যাঁ, আমার দিদি। তোমাকে ঢুকতে দেখে বললেন না কিছু?
আমাকে,–না তো–আমি তো তাকে দেখিনি!
ভালই হয়েছে। কিন্তু আমি যে এ ঘরে আছি সেকথা—
একটা বাচ্ছা ছেলে বলল-ননীমামা ওই ঘরে পড়ে আছে।
পড়ে আছে শুনে আশ্চর্য হতে বলল–রাতদিন তো পড়েই থাকে।
খুব ভুল বলেনি।
কেন–আগে তো খুব ব্যস্ত দেখতাম!
সে তো আগে। জীবনের সব ব্যস্ততা যখন নিয়েই নিল ভগবান, আর
কী মুশকিল, ভগবান আবার তোমার কী নিতে এল! যাক একটু বসতে বলবে, দাঁড়িয়েই থাকব?
ননী একটু ক্ষুব্ধ হাসি হাসে–বসতে বলতে সাহস হচ্ছে কই? তোমার উপযুক্ত আসন এখানে কোথায়?
বাঃ চমঙ্কার কথা বলতে শিখেছ তো! তুমিও গল্পের বই পড়া ধরেছ নাকি?
ধরতে হয় না, নিজেরাই তো এক একটা গল্প। যাক বসবে তো বোসো। এছাড়া তো আর জায়গা নেই।
কমলা বসে পড়ে। বসবার পরেই কিন্তু চুপ হয়ে যায়। চেষ্টা-যত্ন করে অনেকখানি সপ্রতিভতা নিয়ে এসেছিল, প্রথম ধাক্কায় খরচ হয়ে গেছে সেটুকু। এখন বোবা।
ননী একটু অপেক্ষা করে বলে, দাঁড়াও তোমার জন্যে একটু চায়ের চেষ্টা দেখিগে।
তুমির দূরত্বটা অজ্ঞাতে কখন থেকে যে এসে পড়েছে।
না না, থাক ননীদা, কোন দরকার নেই।
ননী একটু থেমে বলে, চা খাবার দরকার নেই সত্যি, কিন্তু দিদিকে একটু জানিয়ে আসা ভাল। নয়তো হঠাৎ দেখে কী না কী ভেবে বসবেন!
এবার একটা কথার বিষয় পেয়ে বলে কমলা, কী বলবে?
বলব? গোঁজামিল করে বুঝিয়ে দেব যা হয়–বলব আমার মনিববাড়ির একটি মেয়ে এসেছে ফটোর তাগাদা দিতে!
আমাকে তোমার মনিববাড়ির মেয়ে বলে বিশ্বাস করবে?
বিশ্বাস! ননী সহসা আবেগরুদ্ধ স্বরে বলে, আমার মনিব তো সামান্য। তার চাইতে তো অনেক উঁচুডালের ফুল হয়ে যাচ্ছ! তাতেই কি বেমানান দেখাচ্ছে?…রাজার রানী বললেও তোমায় কেউ অবিশ্বাস করতে পারবে না কমলা! বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ননী। মোমবাতির আলোয় ওর মুখ দেখা গেল না, শুধু কণ্ঠস্বরটা বেচারার অবোধ হৃদয়ের বেদনাকে যেন ঘরের সমস্ত বাতাসে ছড়িয়ে দিল।
একটু পরেই একটা মোটা কাপে এক পেয়ালা চা নিয়ে ঢোকে ননী–তোমার ভাগ্য ভাল কমলা, চা একেবারে মজুত ছিল! দিদির তো অনেক প্রস্থ হয়!
দাও। হাত বাড়িয়ে কাপটা নিয়ে আস্তে আস্তে চা-টা খেতে থাকে কমলা। যেন এই জন্যেই এসেছে।
ননী একটু পরে বলে–কিন্তু আজ তুমি এভাবে এলে কেন তাই ভাবছি। বিয়ের নেমন্তন্ন করতে, না ধিক্কার দিতে?…তাই দাও। যত পারো দাও। শুধু কথা দিয়ে যদি না কুলোয় রাস্তার ধুলো এনে গায়ে দাও। বোধহয় তাতেও হবে না। যে জানোয়ারের মত কাজ আমি করেছি সেদিন, তার শাস্তি হচ্ছে চাবুক।
জানোয়ারের মত! কমলা হেসে উঠে বলে, না ননীদা, তুমি ঠিক মানুষের মতই কাজ করেছ। এমন ক্ষেত্রে মানুষ মাত্রেই এ কাজ করে। শুধু মানুষ কেন, দেবতারাও ক্ষেপে ওঠে এ জায়গায়।
কিন্তু কমলা, আমি নিজেকে নিজে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। যখনি ভাবব হিংসেয় অন্ধ হয়ে কী ভীষণ ক্ষতিটাই তোমার করতে চলেছিলাম!..ভগবান তোমার সহায় হল, তাই হল না– নইলে
আমি বলছি তোমার কিছু দোষ হয়নি ননীদা, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর কী যে সেদিন হল কিছুই জানতে পারলাম না। মোটা ভদ্রমহিলা কী বললেন তোমায়?
আমায়?–আমি কি সেখানে তিষ্ঠোতে পেরেছি কমলা, কাপুরুষের মতন পালিয়ে এসেছি।
পালিয়ে এসেছিলে?
হ্যাঁ কমলা, পালিয়েই এসেছিলাম। তোমাকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে
তুমি আমাকে পরের মতন তুমি তুমি করছ কেন ননীদা? শুনতে ভাল লাগছে না।
ভাল লাগছে না?
কিন্তু যে মস্ত এক বড়ঘরের বৌ হতে যাচ্ছে, তাকে একটা রাস্তার ভ্যাগাবন্ড তুই বললেই বা ভাল শোনাবে কেন কমলা?
শুনব তো আমি!
কমলা!
উঁহু, কমলি?
কমলি, কমলি–কেন আর একমুঠো ভিক্ষে দিয়ে মায়া দেখতে এসেছিস? এর থেকে তুই আমায় লাঞ্ছনা করলেই আমার ছিল ভাল। বুঝতাম তবুও যে অনেক উঁচুতে উঠে যাসনি তুই…। সেদিনের জন্যে আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইতেও চাই না কমলি, তুই খুব লাঞ্ছনা কর আমায়।
কেন তা করব? কমলা বলে, যা করেছিলে ঠিকই করেছিলে। বার-বার তো বলছি, তুমি ভেবেছিলে বড়লোকের হাত থেকে উদ্ধার করবে। আমরা হয়তো ধিক্কার দিতাম, যদি তুমি অসহায়ের মত কোন চেষ্টা না করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে।
কিন্তু তা যদি দিসনি, কী বলতে তাহলে এসেছিস? ননী বলে।