আষাঢ়ে গল্পে কেউ কম যায় না। অনর্গল বানাতে থাকবেন নীহারকণা, কাহিনীকে জোরালো করবার জন্যে নতুন নতুন সংযোজনা করেন। ইন্দু যে বাড়ি ফিরেছে, নিজের ঘরে ও নিজের থালায় ভাত খাচ্ছে, এই কৃতার্থতায় সব কিছুই করতে প্রস্তুত নীহারকণা।
.
এদিকে এই নাটক চলছে, ওদিকে কুরুক্ষেত্র চলছে কেষ্টমোহিনীর সংসারে।
কমলা চলে গেছে।
ওদের তাঁত-স্কুলেরই এক ছাত্রীর বাড়িতে থাকতে গেছে। বয়সে অনেক বড় সে, তা হোক, বন্ধু হয়ে গেছে। বাড়িতে অশান্তি বলে কয়েকদিনের আশ্রয় চেয়েছে।
সেখানে এই কদিন ধরে শুধু ভাবছে কমলা। আকাশ-পাতাল ভাবছে।
সেই ভাবনা-সমুদ্রের জলে কি তৃষ্ণা মেটে?
.
ওদিকে কেষ্টমোহিনী বুক চাপড়াচ্ছে। দুধকলা দিয়ে কালসাপ পোর নজির তুলে অনবরত শাপশাপান্ত করছে কমলাকে!
ছি ছি, এতদিনের ঋণের এই শোধ? বিয়ে করে ড্যাং ড্যাং করে বরের ঘরে গিয়ে উঠবি?
পড়শীরা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ওলো কেষ্ট, অত ফুঁসে মরছিস কেন? ভালই তো হলো, বুড়ো বয়সে আর উঞ্ছবৃত্তি করতে হবে না, বড়মানুষ জামাই মাসোহারা দেবে!
কেষ্টমোহিনী সতেজে বলে, ঝাটা মারি অমন মাসোহারায়। কেষ্ট বোষ্টমী ভিক্ষের ভাত খায় না।
.
কেষ্টমোহিনীদের অনেকেরই হয়তো এই জীবনদর্শন। হাত তুলে কেউ কিছু দিলে সে প্রাপ্তি তাদের কাছে জোলো বিস্বাদ, ঠকিয়ে আদায় করে আনার মধ্যে অনেক রোমাঞ্চ। আর জীবনের শুরু থেকে উপার্জনের যে পথ দেখেছে, সেই তাদের কাছে সিধে সহজ স্বাভাবিক।
তাই বিয়েতে এদের বিরক্তি! বিয়ে হওয়া মানেই তো ফুরিয়ে যাওয়া!
.
ফটোর জন্যে ডার্করুম নয়। এমনি সন্ধ্যার পর আলো নিভিয়ে চুপচাপ নিজের খোপটুকুতে শুয়েছিল ননী।
দূর সম্পর্কে এক দিদির বাসায় খরচ দিয়ে থাকে সে। একক এই ঘরটুকু সেই দিদির বদান্যতা। আগে এ ঘরে শুধুই কাঠ খুঁটে আর সংসারের সব আবর্জনা থাকত, ননী আসার পর থেকে আবর্জনাগুলোকে কোণঠাসা করে ননীও থাকে।
তবু এটুকুকেই স্বর্গ বলে মানে ননী। তবু তো একেবারে নিজস্ব। দরজাটায় খিল লাগিয়ে শুয়ে পড়লে তো সম্পূর্ণ একা হবার অপূর্ব সুখটুকু আছে। রাতে কারুর কাঠ খুঁটে দরকার হবে না।
দিদি বলেছিল গোড়ায়, তুই এখানে এই দালানের একপাশে শুবি।
দালান মানে যেখানে দিদির সমগ্র সংসার। তাছাড়া ওই দালানের একপাশে দিদির বড় ছেলে দুটো শোয় দুখানা চৌকি পেতে। দিদি জামাইবাবু আর দিদির আরও গোটাপাঁচেক ছেলেমেয়ে রাত্রে না হক দশবার ওঠে, আর ওই দালান দিয়েই আনাগোনা করে।
বাবাঃ! মানুষের থেকে অনেক ভাল কাঠ খুঁটে!
এই ঘর, ফটোগ্রাফের দোকান, আর কমলাদের বাসা–এই তিন জায়গায় টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একরকম করে,যদিও কিসে আরও দুপয়সা রোজগার করা যাবে, কী করে কমলাকে উদ্ধার করা যাবে, এই চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে থাকত, তবুও তার মধ্যে বাঁধন ছিল। কিন্তু সহসা এ কী হল, অলক্ষিতে কে কোথায় বসে ননীর প্রাণের সব বাঁধনগুলো এমন করে কেটে দিলে!
সুতোকাটা ঘুড়ির মত লক্ষ্যহীন ননী আজকাল বেশির ভাগ সময় এই ঘরেই পড়ে থাকে। অসময়ে খায়, অসময়ে ঘুমোয়, অসময়ে কাজে যায়।..ময়লা জামাকাপড় পরতে ভালবাসত না, কদিন তাই-ই পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন কিছুর জন্যে আর কিছু দায় নেই ননীর।
আচ্ছা, তবে আর ননীর এখানে পড়ে থাকার দরকার কী? কী দরকার স্টুডিওর মালিকের আর দূর সম্পর্কের দিদির খোশামোদে করবার? সব ছেড়েছুঁড়ে বেরিয়ে গেলেই তো আপদ চুকে যায়!
ধর, কাল ভোরেই যদি কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ে ননী?…কী হবে? কিছুই না। কারুরই কিছু এসে যাবে না।
আর ননীর?… তারই বা এসে যাবে কী? জীবনে যদি আর কোনও উদ্দেশ্য না রইল, যন্ত্রণা কোথায়? একটা পেট–চালিয়ে নেওয়া এমন কিছু শক্ত নয়। আর যদিই বা না চলে, ননী মারা পড়লেই বা জগতে কার কী ক্ষতি?
ননীর মত লোকেদের জন্মানই ভুল। অতএব যত তাড়াতাড়ি সে ভুলের পরিসমাপ্তি হয়, ভালই। পৃথিবীর কিছু অন্ন বাঁচবে
.
ঘরের দরজায় হঠাৎ টোকা পড়ল।
চমকে উঠে বসল ননী। দরজায় টোকা দেয় কে?
টোকা দিয়ে মৃদু পদ্ধতিতে ডাকবার লোক তার কে আছে? খাবার টাইম হলে রান্নাঘর থেকে দিদির কাংস্যকণ্ঠ ধ্বনিত হয়,–এই ননী আসবি, না সমস্ত রাত হাঁড়ি আগলে বসে থাকব? ফি রোজ বাবুকে ডেকে ডেকে তবে খানা-ঘরে আনতে হবে, কোনদিন নিজে থেকে ঠাইটা করে জলের গ্লাসটা নিয়ে বসতে নেই? কটা দাসী বাঁদী আছে তোর?
কথাগুলো শুনতে যত কটু, তত গুরু নয়। দিদির কথাই ওই রকম। গুরুত্ব কেউ দেয় না ওর কথায়।
ভগ্নীপতি যেদিন তখনও আহার-নিরত থাকেন, মৃদু হাস্যে বলেন, তা সেটা তো তোমারই দেখা দরকার। ওর নিজস্ব একটা বাঁদী জোগাড় করে দেওয়া তো তোমারই
এ ধরনের কথা বললে অবশ্য কথা আর শেষ করতে হয় না তাকে। দিদি ফোঁস করে ওঠেন, কী! কী বললে?..বাঁদী? পরিবারকে তোমরা তাই ভাবো বটে!
লেগে যায় ঝমাঝম।..ছেলেমেয়েগুলো হি হি করে হাসে।
কাজেই এ বাড়িতে এমন সূক্ষ্মবৃত্তির চাষ কোথাও নেই যে মৃদু টোকা দিয়ে দরজা খোলাতে চাইবে। তাছাড়া দরজা তো বন্ধ নেই, শুধু ভেজানো।
.
উঠে দরজা খোলবার আগেই ভেজানো দরজা খুলে যে মানুষটা ঢুকল, তাকে দেখে পাথর হয়ে গেল ননী।
দেখতে যে পেল, সে শুধু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে কিঞ্চিৎ আলো ঢোকায়।…দেখতে পেল, তবু না করল কোন প্রশ্ন, না করল অভ্যর্থনা, শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।