সহসা উঠে দাঁড়ান চন্দ্রনাথ। ক্লান্তস্বরে বলেন, তোমার কথাই বোধ হয় ঠিক দিদি।
যাক তবু মানলি! কিন্তু ও যা চাইছে তার কী?
চন্দ্রনাথ আর একবার ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে বলেন, কী চাইছে?
এই দেখ! সপ্তকাণ্ড রামায়ণ শুনে বলে কি না সীতা কার পিতা! ও যে বলছে এইখান থেকে আমরা ওকে ওই ছুঁড়ির সঙ্গে নেয্যমত বিয়ে দিই!
চন্দ্রনাথ ধীরস্বরে বলেন, যা হয় না তা হওয়ানো যায় না দিদি।
যা হয় না! নীহারকণা একবার বিচলিত দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকান, বোধ করি বুঝতে চেষ্টা করেন চন্দ্রনাথের এ কথাটা ঠিক কোন পর্যায়ের! নীহারকণাকে ব্যঙ্গ?…নাকি ছেলের এই সব দুষ্টু প্যাচালো বুদ্ধিতে এসে গেছে বিরূপতা?
তাই মনে হচ্ছে..বিয়ের কথা উড়িয়ে দিতে চাইছে।
সহসা নীহারকণা ভয়ানক একটা উল্টোপাল্টা কথা কয়ে বসলেন–যা হয় না তা হবে না বলে দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে তো চলবে না চন্দর। ছেলের বিয়ে দিতেই হবে। আর ছেলে যদি রাস্তার ভিখিরীর মেয়েটাকেও বিয়ে করতে চায় তো তাই দিতে হবে। যেমন যুগ পড়েছে। –আমি এই চললাম পুরুতকে খবর দিতে।
বলে মেদিনী কাঁপিয়ে চলে যান নীহারকণা। বোধ করি তদ্দণ্ডেই পুরুতকে খবর দিতে।
.
এই স্বভাব নীহারকণার। যে কোন ব্যাপারে অপরের বিরুদ্ধতা তিনি করবেনই। তাতে প্রতিপদে পরস্পরবিরোধী কথা বলতে হয় বলবেন, দ্বিধামাত্র না রেখে সজোরেই বলবেন। যতক্ষণ চন্দ্রনাথ ছেলের সমর্থন করছিলেন ততক্ষণ নীহারকণা সেই একান্ত স্নেহপাত্রের উপরও খড়গহস্তের ভূমিকা নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন। যেই দেখা গেল চন্দ্রনাথ ছেলের ব্যাপারে হতাশ হচ্ছেন, সেই মুহূর্তে নীহারকণা তার দিকেই হাল ধরলেন।
হয়তো একা নীহারকণাই নয়, সংসারে এমন লোক আরো অনেক আছে। অপরের মত খণ্ডন করবার দুর্নিবার বাসনায় অহরহ তারা নিজের মত খণ্ডন করে। অপরের সমর্থিত নীতিকে নিস্যাৎ করবার জন্য সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলতে লেশমাত্র দ্বিধা করে না।
.
নীহারকণা এমনিই।
তবু নীহারকণার স্নেহটা মিথ্যা নয়। ইন্দ্রনাথের অভাবে যে শূন্য মন অবিরাম হাহাকার করছিল, সে মন ইন্দ্রনাথের জন্য বড় একটা কিছু করতে চাইছিল। হয়তো অবচেতনে, হয়তো অবচেতনেরও অগোচরে। চন্দ্রনাথের সঙ্গে বিরুদ্ধতার পথ ধরে সেই বাসনাটা মেটবার পথ হল।
তাছাড়া অনেকদিনের সঞ্চিত সেই নিরুদ্ধ বাসনা। যে বাসনাকে ইন্দ্রনাথ তার ছাই-পাঁশ দেশের কাজের ছুতোয় বিকশিত হতে দেয়নি।…এতটা কর্মক্ষমতা, এতটা এনার্জি সমস্তই আজীবন বরবাদ হয়ে চলেছে। এত স্তিমিত জীবন ভাল লাগে মানুষের?
ইন্দুর বিয়ে হলে নীহারকণা অন্তত এই স্তিমিত জীবনের হাত থেকে রেহাই পান।
.
অবিশ্যি বিয়ে করছে এমন ঘরে যে, লোকের কাছে বলবার নয়, নিজেরও ঘেন্না আসছে, কারণ যা কিছুই বলুক ইন্দ্রনাথ, সে মেয়েকে তিনি জীবনেও বিশ্বাস করতে পারবেন না।
সেদিনের সেই ভাবে-ঢলঢল চোখছলছল মেয়েটি তো? সে তো পাকা অভিনেত্রী। ইন্দু এখন তার আষাঢ়ে গল্প শুনে মোহিত হতে পারে নীহারকণা হবেন না।
তা ছাড়া সেই ছেলেটা? তাকে কী করে মন থেকে মুছে ফেলবেন নীহারকণা? ছেলেটা যে ওই মেয়েটার তাতে কোনও সন্দেহ নেই নীহারকণার, তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রর সন্তান নাও হতে পারে। জোচ্চোর মেয়েমানুষ দুটো উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে কিছু হাতাতে এসেছিল।
হায় ভগবান! দিলে দিলে, এমন কুৎসিত এমন বিকৃত জিনিসটা দিলে কেন নীহারকণাকে? এর চাইতে একটা ভদ্রঘরের কালো কুৎসিত মেয়েও যদি
তবু এ বিয়েতে কোমর বাঁধবেন নীহারকণা। মনকে তিনি প্রস্তুত করে নিচ্ছেন।
যেমন যুগ পড়েছে, এই তাঁর সান্ত্বনা। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো জাত অজাত কিছু মানছে না, সত্যিকার থিয়েটার বায়স্কোপের মেয়েছেলেদের বিয়ে করে পরমার্থ লাভ করছে! একটা বিয়ে ভেঙে তক্ষুনি আর একটা বিয়ে করছে, আরও কী করছে আর কী না করছে!
কন্দর্প যে অন্ধ, এ সত্যটা এ যুগে বড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অতএব মেনেই নিচ্ছেন তিনি।
কী আর করবেন! বৌটাকে একবার গঙ্গায় চুবিয়ে আনবেন, জগন্নাথের মহাপ্রসাদ খাইয়ে দেবেন, আর নিত্য শিবপূজো ধরাবেন!
দস্যু রত্নাকরের পাপ কেটেছিল, বিল্বমঙ্গলের পাপ কেটেছিল, আরও আরও কত মেয়ে পুরুষেরই এমন মহাপাপ কেটে যাওয়ার উদাহরণ বেদে পুরাণে আছে, আর একটা বিশবাইশ বছরের মেয়ের পাপ কাটানো যাবে না?
তবে হ্যাঁ, বাড়ির চৌকাঠের ওধারে পা-টি ফেলতে দেবেন না তাকে। বাঁচালতা বেহায়াপনা সব ঢিট করবেন। সেই মা না মাসি মাগী–তাকে ত্রিসীমানায় আসতে দেবেন না।..বৌকে আরও কী কী করতে দেবেন আর দেবেন না, তার কল্পনায় বিভোর হতে থাকেন নীহারকণা।
এটাও কম পুলকজনক নয়। বেয়াড়া একটা কিছু ঢিট করতে পারার মত সুখ কটা-ই বা আছে জগতে?
.
তাছাড়া আপাততও রয়েছে কাজ।
বিয়ের ঘটা বাদে
আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখ রাখবার জন্যে গল্প বানানো। রেখে ঢেকে বানিয়ে গুছিয়ে বলতে হবে তো! হবে বলতে-মা বাপ মরা গরিবের মেয়ে, পয়সার অভাবে বিয়ে হচ্ছিল না, তাই ইন্দুর আমার দয়ার শরীর, কথা দিয়ে বসেছে..।
আমি কি ওই ডোমের চুপড়ি-ধোওয়া মেয়েকে ঘরে আনতে সহজে মত দিয়েছি? ওই নিয়ে ছেলের মান অভিমান, বাড়ি ছেড়ে কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়ে থাকা! সেখানে বাছার হাড়ির হাল একেবারে! আর শক্ত হয়ে থাকতে পারলাম না, মত দিয়ে মরলাম–বলি থাকগে মরুক গে, গয়নাগাঁটি তত্ত্বতাবাস না হয় নাই হলো, ইন্দুর আমার অভাব কী?