দ্যাখ চন্দর, গোলমেলে কথা রাখ। আমি হচ্ছি খাঁটি কথার মানুষ। স্পষ্ট করে বল, ইন্দ্রর সঙ্গে ওই মেয়েটার কোন দুষ্য সম্পর্ক আছে কি নেই? কী তোর বিশ্বাস?
ইন্দ্রর সঙ্গে কারুর কোন দুষ্য সম্পর্ক থাকতে পারে, একথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব দিদি।
তা হলে বল, আর কি?…লুকিয়ে সে ওকে বিয়ে করেছে?
বিয়ে করলে সে লুকিয়ে করত না।
তবে কথাটা কী দাঁড়াচ্ছে চন্দর? সেদিন থেকে আজ অবধি এই যে ঘটনাটা ঘটল সমস্তই বাজিকরের ভোজবাজি?
এমন অদ্ভুত কথা আমি বলি না দিদি, শুধু এটা অনুভব করছি কোথাও কোনখানে একটা কিছু ষড়যন্ত্র চলছে।
তাই যদি তো ইন্দুরই খুলে বললে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়? সব সরল হয়ে যায় তাহলে!
বলতে ওর ধিক্কার আসে দিদি। আমরা যে তাকে অবিশ্বাস করেছি, এইটাই তো আমাদের পক্ষে ভয়ঙ্কর একটা লজ্জার কথা। সে আবার কোন্ লজ্জায়–
থাম তুই চন্দর, সংসার চলে সাধারণ মানুষ দিয়ে। অত কাব্যি কথা সবাই বোঝে না। আমি বুড়ো-হাবড়া মুখ মেয়েমানুষ, আমি যদি একটা গোলকধাঁধায় পড়ে দিশেহারা হই-বুঝিয়ে দিতে হবে না আমায়?
চন্দ্রনাথ বলেন, গোলকধাঁধায়ও পড়তে হত না, আর দিশেহারাও হতে হত না দিদি, শুধু যদি ইন্দ্রর ওপর বিশ্বাস রাখতে পারতে।
বেশ নীহারকণা থমথমে মুখে বলেন, আমি পারিনি, তুমি তো পেরেছ? ফয়সালা একটা কর!
জোর করে ঠেলেঠুলে কিছু করা যায় না দিদি, যখন সময় আসে সমস্ত জটিলতার জাল আপনিই খুলে পড়ে, সমস্ত ভুল ধারণা ভুল বলে ধরা পড়ে। ঠিক সময়টি আসার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়।
অপেক্ষা করতে হয়? ও! নীহারকণা তীব্রস্বরে বলেন, মানুষ বোধ করি অমর বর নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে, তাই সব কিছুর জন্যে অপেক্ষা করবার সাধনা করবে। আমি তোমাকে এই বলে রাখছি চন্দর, ইন্দুর কাছে আমি যাব। সেই মেয়েকে আমি আর একবার দেখব, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করব–বল, তোদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কী? দেখি কী উত্তর দেয়? –বেগতিক দেখে মূৰ্ছা গিয়ে বসতে পারলেই কি সব সময় পার পাওয়া যায়?
অপেক্ষা! অপেক্ষা! বলতে পারলিও তো! অপেক্ষা করবারও একটা মাত্রা আছে! ছেলেটা আজ এই এতদিন বাড়িছাড়া, কোন মায়াবিনী যে তাকে
সহসা বিদ্যুৎগতিতে বাচ্চা চাকরটা এসে বিদ্যুৎবেগেই খবর দেয়, পিসিমা, দাদাবাবু!
দাদাবাবু! কী দাদাবাবু?
দাদাবাবু এয়েছে।
এ্যাঁ, কী বললি? নীহারকণা পরনের থানের আঁচল লুটোতে লুটোতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে পাগলের মত, বলেন, কোথায়? কোথায় সে মুখপোড়া হতচ্ছাড়া ছেলে! বাইরে এসে চাকর দিয়ে খবর পাঠিয়েছে?…চন্দর, তুই বসে রইলি?..ভাইকে ধিক্কার দিয়ে ছুটে নিচে নামতে গিয়ে বাধা পান নীহারকণা।
ইন্দ্রনাথ ওপরে উঠছে।
.
আসছিলেন পাগলের মত, কিন্তু যে মুহূর্তে দেখা, চট করে নিজেকে সামলে নিলেন নীহারকণা, গম্ভীর হয়ে গেলেন, বললেন ওঃ ইন্দ্রনাথবাবু! হঠাৎ এ বাড়িতে যে?
ইন্দ্রনাথ বোধ করি বর্মাবৃত চিত্তেই এসেছে, তাই প্রসন্নহাস্যে বলে, এলাম, কথা আছে।
কথা? নীহারকণা ভুরু কুঁচকে বলেন, আমার সঙ্গে কিসের কথা?
আছে আছে। চল না। পিসিকে প্রায় বেষ্টন করে ঠেলতে ঠেলতে ওপরে ওঠে ইন্দ্রনাথ।
প্রাণটা জুড়িয়ে যায় নীহারকণার। তবু স্বভাব যায় না মলে, তাই অমায়িক মুখে বলেন, তা সে মেয়েটির খবর কী? মূর্ছা ভেঙেছে?
ইন্দ্রনাথ বিচলিত হবে না। তাই সহজ সপ্রতিভ কণ্ঠে বলে, আপাতত ভেঙেছে।–এখন চল সব শুনবে। শুনে তুমিই হয়তো আবার মূৰ্ছা যাবে।
আমাদের অত মোমে-গড়া শরীর নয় খোকা যে মূর্ছা যাব! তা কথাটা কী?
বাঃ, মস্ত একটা দামী খবর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনে নেবে? তা হবে না। রীতিমত আসনে বসে হাতে সুপুরি নিয়ে শুনতে হবে।
ঢং রাখ খোকা! বল আমায়–তোর এ ঘূর্তির মানে বুঝছি না। দেখি কী বার্তা এনেছিস!
হ্যাঁ শুনলেন, স্থির হয়েই শুনলেন সব।
.
ব্যঙ্গ করে ইন্দ্রনাথকে বলেছিলেন নীহারকণা, শুনি, কী বার্তা? কিন্তু সত্যিই কি ভাবতে পেরেছিলেন সে বার্তা এত ভয়ঙ্কর হবে? ভাবা সম্ভব?
আশ্চর্য! আশ্চর্য!…বলতে একটু বাধল না?.মায়াবিনী জাদুকরী এমন জাদুই করল।
চন্দ্রবাবুর যে বড় লম্বাচওড়া কথা হচ্ছিল, স্বচক্ষে দেখাটাও কিছু নয়, বরং নিজের চোখকে অবিশ্বাস কোরো তবু বিশ্বাসভাজনকে অবিশ্বাস কোরো না। নাও এখন শোনো এসে?
উঃ, কী ভয়ঙ্কর।
এসে আর শুনতে হয় না চন্দ্রনাথকে, নীহারকণা নিজেই গিয়ে শুনিয়ে আসেন। সবিস্তারেই শোনান, এখন বুঝতে পারছ ব্যাপার? হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়ে বাছা এখন এক আষাঢ়ে গল্প কেঁদে সুয়ো হতে এলেন! নাও তোমরা এখন সেই ঘর-ঘরকন্না করা বৌকে নতুন করে সিঁথিমৌর পরিয়ে দুধে-আলতার পাথরে এনে দাঁড় করাও! তোমার খাঁটিছেলে আবদার নিয়েছেন –আস্তাকুঁড়ের জঞ্জাল এনে লক্ষ্মীর চৌকিতে তুলবেন, তুমি সে গোড়ে গোড় দাও দিয়ে–উঃ, আমি শুধু ভাবছি চন্দর কী ডাকিনীদের খপ্পরে গিয়েই পড়েছিল বাছা, তাই অমন সরল সদানন্দ ছেলে এমন হয়ে যায়! এত প্যাচোয়া বুদ্ধি ওকে দিচ্ছে কে? ওই শয়তানীরা ছাড়া?
বলা বাহুল্য চন্দ্রনাথ নীরব।
বলি চুপ করে রইলি যে?
বলবার আর কিছু নেই দিদি।
তোর কী মনে হচ্ছে? ইন্দুর সব কথা সত্যি? আমায় তো তখন খুব হেয় দিলি-বলি, এখন সেই সর্বনাশীদের মন্ত্রণা নিয়ে এসেছে কিনা ইন্দু? নইলে যে ছেলে কাল অত তেজ দেখিয়ে মুখের সামনে দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল, আজ সে একগাল হাসি নিয়ে বিয়ে দাও আমার বলে আবদার করতে আসে?