ইন্দ্রনাথ হেসে ওঠে সহজ প্রসন্ন হাসি, সেখানে আবার ওই পিসিমা! কী করব বল, মাসি পিসি ভাগ্যটা তোমার সুবিধের নয়!
না, না, না!…কমলা আবার আর্তনাদ করছে, এ হয় না! এ অসম্ভব!
হয় কমলা। ইন্দ্রনাথ দৃঢ়স্বরে বলে, জগতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। পাঁক থেকে পদ্ম তুলে দেবতার চরণে দেওয়া যায়, জানো তো? কেন যায় জানো? পদ্মের গায়ে পাক লাগে না বলে!
কিন্তু আপনি বুঝছেন না। আমি কোন মুখে আবার আপনাদের বাড়িতে–না, না, না!…এমন ভয়ঙ্কর আদেশ আপনি আমায় করবেন না!
আদেশই যদি বলছ তো–ইন্দ্রনাথ ফের হাসে–না হয় বলে শাস্তি, ভয়ঙ্কর দোষ করেছ, তার শাস্তিটাও ভয়ঙ্কর হোক। কিন্তু আজ যাই, অন্ধকার হয়ে গেছে, অস্বস্তি হচ্ছে। কোনখান দিয়ে গেলে তোমার ওই মাসির সামনে পড়তে হবে না বলে দিকি, সেই পথ দিয়ে যাই। উঃ, কী সাংঘাতিক!
মৃদু হেসে চলে গিয়ে ইন্দ্রনাথ আবার কী ভেবে ফিরে এসে বলে, কিন্তু কমলা, সেই ভাড়া করা ছেলেটাকে একবার দেখাতে পার আমায়?
কমলা ভীতকণ্ঠে বলে, কেন?
একবার দেখতাম। শুনেছিলাম নাকি অবিকল আমার মত দেখতে।
কমলা নিশ্চিন্ত হয়ে হাসে, ওটা পিসিমার মনের ভ্রম। আপনার মত ফরসা তাই।
ইন্দ্রনাথ চলে যায়।
কমলা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে দেবার কথা বিস্মৃত হয়ে বসে থাকে পুতুলের মত।
.
এ কী হল! এ কী হল!
কমলার ভাগ্যদেবতা কমলার সঙ্গে এ কী নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের খেলা খেলতে চাইছেন! তবু সমস্ত আবেগ উত্তেজনা, ভয় আতঙ্কের দুরন্ত আলোড়ন ছাপিয়ে, কাঁধের উপর মৃদু একটি স্পর্শের অনুভূতি মৃদু একটি সৌরভের মত জড়িয়ে থাকে সমস্ত সত্তাকে, সমস্ত চেতনাকে।
আশ্চর্য! আশ্চর্য! এখনো কমলা বেঁচে আছে? সেই অসহ্য সুখে মরে যায়নি সেই মুহূর্তে?
তখন ছিল শুধু ভালবাসা, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হল শ্রদ্ধা।–একথা কার জন্যে উচ্চারিত হল? কমলার জন্যে?
কিন্তু… কিন্তু এত সুখ কি মানুষের সহ্য হয়?..বন্যার জলে কি তৃষ্ণা মেটে?..দাবানলে কি শীত ভাঙে?…না না, এত সুখ সহ্য করতে পারবে না কমলা!
যুদ্ধে পরাজিত সেনাপতির মত ফিরে এলেন নীহারকণা। এতখানি অপমানিত অপদস্থ জীবনে কখনো হননি বললেও কিছুই বলা হয় না। এ যেন মরেই গেছেন তিনি। সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে, হয়তো বা গোড়া থেকে আজ পর্যন্ত সবটাই কোন গভীর ষড়যন্ত্র। নইলে যে ছেলেটা খবর দিয়ে নিয়ে এল হাতে-নাতে ধরিয়ে দিতে, সে হঠাৎ পালালো কেন?
আর ইন্দ্র? অপরাধী কখনো অতখানি বুকের পাটা দেখাতে পারে? কিন্তু মেয়েটা…? সে যে সেই সেদিনের মেয়েটা তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। একেই তো রীতিমত মনে রাখবার মত মুখ চোখ, তাছাড়া নীহারকণার বুকের ফলকে আগুনের অক্ষরে আঁকা আছে যে সে মুখ। তার ওপর আবার প্রধান সন্দেহজনক–বেগতিক দেখে মূৰ্ছা যাওয়া।
তবে? অঙ্কগুলো ঠিক দেখাচ্ছে, যোগফল মিলছে না। আরো তার মর্মান্তিক দুঃখ, চন্দ্রনাথ যে কার পক্ষে বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, নীহারকণাকেই যেন মনে মনে দোষী করছেন তিনি। যেন নীহারকণার সেই দোষ বুঝেও নীরব হয়ে আছেন শুধু ধিক্কারে। তা মুখ ফুটে কেন বলুক না চন্দ্র, দিদি, তোমার ভুল হয়েছে! তাও বলবে না, শুধু কেমন একরকম নীরেট পাথরের মত মুখ করে বসে থাকবে। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে নীহারকণার।
ওঃ, এই জন্যেই বলে পরের ছেলের ওপর বেশি মায়া ঢালতে নেই। স্বয়ং মা যশোদাই যে বলেছেন, কাকের বাসায় কোকিল থাকে যতদিন না উড়তে শেখে, উড়তে শিখে ধর্ম রেখে চলে যায় সে অন্যবন।–পর কখনো হয় কি রে আপন?
এত বড় একটা দৃষ্টান্ত চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও কেনই যে মানুষের শিক্ষা হয় না! গুম হয়ে বসে থাকলেন নীহারকণা অনেকক্ষণ, তারপর হঠাৎ সংকল্প স্থির করে ফেললেন। হেস্তনেস্ত একটা করা দরকার। স্পষ্টাস্পষ্টি জিগ্যেস করবেন চন্দ্রনাথকে–কী সে চায়? যদি বলে যে নীহারকণাই যত নষ্টের গোড়া, তা বলুক–বেশ, চলে যাবেন নীহারকণা। আর কিছু না হোক, বাবা বিশ্বনাথের কাশী তো কোথাও পালিয়ে যায়নি?
থাকুক চন্দ্র যেমনভাবে থাকতে ইচ্ছে। ছেলের পায়ে ধরে ডেকে আনুক, আনুক তার সেই মায়াবিনী ছলনাময়ীকে, সংসারকে আস্তাকুঁড় করে বাস করুক সুখে-স্বচ্ছন্দে।
.
চন্দ্র! এসে বসলেন নীহারকণা চন্দ্রনাথের ঘরে।
কী দিদি?
বলি, তুই যে একেবারে মৌনব্রত নিলি, এর মানে?
তাছাড়া একটু হাসলেনই চন্দ্রনাথ, আর কী করব?
এতবড় একটা কাণ্ড চোখের ওপর দেখে এলি, সে বিষয়ে কী বুঝলি না বুঝলি একটা আলোচনা করবি তো?
চন্দ্রনাথ মৃদুস্বরে বলেন, সব কথাই কি আলোচনার উপযুক্ত?
বেশ, তোর মনের কথাটা তো খুলে বলতে পারিস? মনের কথা চেপে গুম হয়ে বসে থাকাই জগতের যত অনর্থের মূল তা জানিস?–হতে পারে তোরা বাপবেটা খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু জগতের সবাই তো তোদের মত এতবড় বুদ্ধিওলা নয়; তারা যদি তোদের ইচ্ছে অনিচ্ছে রুচি পছন্দর দিশে না পায়? জগতের এই সব কমবুদ্ধি লোকেদের জন্যে কিছু সহজ ব্যবস্থা না রাখলে চলবে কেন?
তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না দিদি! বলতে আমি কিছু চাইছি না চন্দর, তুমি বল তাই শুনতে চাইছি। আজকের ঘটনাটা দেখে কী মনে হল তোমার বল শুনি।
মনে? যদি মনে কিছু হয়ে থাকে তো এই হল আমরা স্বচক্ষে দেখার যুক্তি দিয়ে কতই না বড়াই করি! আমাদের এই চোখে দেখার সীমানার বাইরে আর একটা যে অদেখা জগৎ আছে সে কথাটা ভুলেই থাকি। স্বচক্ষে দেখাটাও একটা বিরাট ফাঁকি হতে পারে