তা করেছে সত্যি, একশবার সে ঋণ স্বীকার করব, কিন্তু আর কিছু করবার নেই আমার। বুঝতে পারছি আমি অকৃতজ্ঞ, আমি নিষ্ঠুর, বুঝেও উপায় নেই আমার। কী করব, অকৃতজ্ঞ হবার জন্যেই ভগবান আমায় গড়েছেন। মাসি বলে অকৃতজ্ঞ, ননীদা বলবে অকৃতজ্ঞ, আর আপনি! আপনার হয়তো সেটা বলতেও প্রবৃত্তি হবে না! মাথা নিচু করে কমলা।
আমি? আমার সঙ্গে কৃতজ্ঞতা অকৃতজ্ঞতার প্রশ্ন কী?
কিছুই নেই? কমলা উত্তেজিত স্বরে বলে, আপনি মহৎ, তাই একথা বলতে পারছেন। কিন্তু আমি তো জানি আপনার কাছে আমি কী পেয়েছি, আর আপনাকে আমি না, আমার কথা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। মাথাটা আবার নিচু করে কমলা।
ইন্দ্রনাথ মিনিটখানেক সেই আনত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, একটা কথা এখনো খুব পরিষ্কার হয়নি।
কী?
ওই যে তোমার ননীদা, কী যেন পরামর্শ দিলে—
সেই তো! সেই জন্যেই তো!..কিন্তু সে বড় বিশ্রী কথা, শুনতে পারবেন কি আপনি?
শুনতে জগতে অনেক কিছুই হয় কমলা, কিন্তু থাক, তোমার হয়তো বলতে কষ্ট হবে।
না, বলব।
দৃঢ়স্বরে বলে কমলা। তারপর ধীরে ধীরে বলে চলে আনুপূর্বিক ইতিহাস।…বলে, এই কুৎসিত পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হওয়ার নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা, আবার মাসির নিষ্ঠুর পীড়নে সেই কাজেই প্রবৃত্ত হতে বাধ্য হওয়া ..একটির পর একটি লোক কীভাবে তাদের শিকার হয়েছে, কী ভাবে ননী অদ্ভুত পদ্ধতিতে ফটোগ্রাফের কায়দায় সম্পূর্ণ অপরিচিত দুটো মানুষকে একত্রে জুড়ে এই শিকারের সহায়তা করেছে, শেষ পর্যন্ত কীভাবে নীহারকণাকে প্রতারণা করে নিয়ে এসেছে তার গলার হার, নগদ টাকা–সবই বলে শেষ করে কমলা, একটা মরীয়া মনোভাব নিয়ে।
.
বলতে বলতে কখন বেলা শেষ হয়ে গেছে, কখন সোনারঙা আলো ঝিমঝিমে হতে হতে মিলিয়ে গেছে খেয়াল হয়নি দুজনের একজনেরও।
বাইরের পৃথিবীতে হয়তো তখনও একটু আলোর রেশ, কিন্তু ঘরের মধ্যে নেমেছে অন্ধকারের যবনিকা। নিচু দেওয়াল টিনের চালাঘরে তো আরো তাড়াতাড়িই নেমেছে।
এখন আর কেউ কারুর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। শুধু স্তব্ধতা। শুধু মৃদু গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ। নাই বা থাকল খুব বেশি বিদ্যে, নাই বা থাকল কথার খুব বেশি বাঁধুনি কিন্তু সরল তো!..খাঁটি তো! বুদ্ধিসম্পন্ন তো! মার্জিতরুচি ভদ্রমেয়ে তো!
তাছাড়া
সুন্দরীও তো।…অনুপম লাবণ্যময়ী..। তা মেয়েদের সৌন্দর্যও একটা গুণ বৈকি! লাবণ্য একটা ডিগ্রী বৈকি!
৪. স্তব্ধতা ভেঙে
অনেকক্ষণ পরে ইন্দ্রনাথই স্তব্ধতা ভেঙে ধীরে ধীরে বলে, একটু আগে তোমাকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম কমলা, এখন নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি। ভাবছি, আমরা কত অল্পেই মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাই, শ্রদ্ধা হারাই। কার্যকারণ বিচার করি না, কোন্ অবস্থায় পড়লে কী করতে বাধ্য হতে পারে মানুষ, তা ভাবি না, নীচতাই যে মানুষের সত্যকার স্বভাব নয়, এসব কিছু না ভেবে বলে উঠিছি ছি ছি।…তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি কমলা।
কমলা যেন ক্রমশ অভিভূত হতেও ভুলে যাচ্ছে। তাই শান্ত স্তিমিত স্বরে বলে, না না, ক্ষমা কিসের? আমি কি জানি না আমি কত জঘন্য, কত নীচ, কত ইতর? তবু-তবু আরও নরকের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আর কোনও উপায় আমি পাইনি!
ইন্দ্রনাথ প্রশান্তভাবে বলে, তোমার পরামর্শদাতার বুদ্ধিটাই অদ্ভুত বাঁকা। ওর চাইতে ভাল কোন উপায় সে আবিষ্কার করতে পারলে না? আশ্চর্য!
কমলাও মৃদুস্বরে জবাব দেয়, আশ্চর্য হবারও কিছু নেই। সেই বা ওর চাইতে ভালর সন্ধান পাবে কোথা থেকে? জীবনে ভাল সে দেখতে পেল কবে? পৃথিবীর কুৎসিত কুশ্রী দিকটাই দেখল, তার কাছে ভাল জিনিসের আশা করব কী করে? তবু তো আমার যা কিছু জ্ঞানের আলো, যা কিছু বুদ্ধি চৈতন্য তার কাছ থেকেই পাওয়া। নিজের কত টানাটানি, তবু আমাকে লাইব্রেরি থেকে না কোথা থেকে বই এনে পড়ায়, কোথা থেকে না কোথা থেকে জোগাড় করে এনে দেয়।
ইন্দ্রনাথ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, কিন্তু কমলা, তুমি তো তাকে শ্রদ্ধাই করো, ভালও বাসো অবশ্যই, তবে তাকে বিয়ে করতে বাধা কী?
সে কথা বলতে পারব না।…তবু বলব বাধা আছে। সে আর হয় না।…কিন্তু বিয়েতে দরকারই বা কী? একটা জীবন এমনি কেটে যেতে পারে না? আমি তো দেখেছি আপনাকে, দেখেছি আপনার সঙ্রে কাজ, দেখে বিশ্বাস এসেছে হয়তো চেষ্টা করলে আর একটা পথ খুঁজে পাব। সৎ পথসভ্য পথ। কিন্তু আমার ভাগ্যই আমার বৈরী!
ভাগ্য কারো চিরদিন বৈরী থাকে না কমলা। ইন্দ্রনাথ আন্দাজে কমলার কাঁধে একটা হাত রেখে গাঢ়স্বরে বলে, এবার আমার ভাগ্যের সঙ্গে তোমার ভাগ্যকে বেঁধে নেব, দেখি এরপর সে আর বৈরিতা সাধন করতে পারে কিনা!
কী বললেন?…কী বললেন আপনি? কমলা যেন ছটফটিয়ে ছিটকে ওঠে, এমন পাগলের মত খামখেয়ালী কথা বলবেন না!
কথাটা পাগলের মত কিনা জানি না–ইন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বলে, কিন্তু খামখেয়ালী খেয়ালের নয়।…এ আমার ইচ্ছে, বাসনা। হয়তো কয়েক ঘণ্টা আগেই তোমাকে একথা বলতাম আমি, যদি না মাঝখানে এতটা সময় এই গোলমালে নষ্ট হত।
সে আলাদা কথা। কমলা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মত বলে, তখন কি আপনি আমার পরিচয় জানতেন?…জানতেন আমি কী?
না, কমলা তা জানতাম না সত্যি-ইন্দ্রনাথ বলে, তাই তখন ছিল শুধু ভালবাসা। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হল শ্রদ্ধা। আজ যাই, যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব। তবে