দেখেছি। কমলার স্বরে মৃদুতা নেই, জড়তা নেই, ও যেন নিজেই নিজের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দিতে দৃঢ়সঙ্কল্প।
ইন্দ্রনাথ বলে, তাহলে এসব সত্যি?
কমলা ঘাড় হেলিয়ে বলে, সব সত্যি।
সমস্ত?
সমস্ত।
আশ্চর্য!..যাক, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তোমার এ ছদ্মবেশ এত সহজে ধরা পড়ল। কিন্তু তবুও বলব তোমার জন্যে আমি দুঃখিত কমলা।…যাক। ইন্দ্রনাথ যাবার জন্যে পা বাড়ায়।
হঠাৎ কমলা দ্রুত এসে ইন্দ্রনাথের পথ রোধ করে দাঁড়ায়, আর কেমন একটা তীব্র স্বরে বলে ওঠে, শুধু দুঃখ জানিয়ে চলে গেলে তো চলবে না, আমার সব কথা শুনে যেতে হবে।
কোন দরকার নেই আমার। আর তাতে প্রবৃত্তিও নেই।
কমলা আচমকা অস্বাভাবিক জোরে হেসে ওঠে, অপ্রকৃতিস্থের মত হাসতে হাসতে বলে,-প্রবৃত্তি নেই? তা থাকবে কেন? আমাদের রূপ দেখতে আপনাদের প্রবৃত্তি আছে, আমাদের হাসি দেখতে আপনাদের প্রবৃত্তি আছে, প্রবৃত্তি থাকে না শুধু আমাদের জীবনের জ্বালা দেখতে!…বলতে পারেন, পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মেয়েমানুষ শুধু পেটের ভাতের অভাবে পুরুষের প্রবৃত্তির আগুনে পুড়ে মরছে বলেই আমাকেও তাই করতে হবে কেন?…আমি কেন বাঁচতে চাইব না? বাঁচবার সহজ কোন রাস্তা যদি খুঁজে না পাই, কেন কাঁটাঝোপ দিয়েও যাবার চেষ্টা করব না?…বলুন?…উত্তর দিন এর?
আপনি দয়ালু, আপনি পরোপকারী, আপনাকেই এর উত্তর দিতে হবে।… উত্তেজনায় পাগলের মত দেখতে লাগে কমলাকে।
ইন্দ্রনাথ ঠিক এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। ঘৃণায় লজ্জায় তার অন্তরাত্মা সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছিল, এখানকার আবহাওয়া নিতান্ত কলুষিত বোধ হচ্ছিল, তাই তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল। সত্যিই কমলার সঙ্গে কথা কইবার প্রবৃত্তি তার ছিল না। কিন্তু কমলার মধ্যে অপরাধিনীর ছাপ কই?
তোমার কথা বুঝতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কমলা। ইন্দ্রনাথ গম্ভীরভাবে বলে, পথ ছাড়ো, যেতে দাও।
না না না, আমার কথা আপনাকে শুনে যেতেই হবে। এরপর হয়তো আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না আমার, কিন্তু আপনার চোখে ছোট হয়ে, হেয় হয়ে গিয়ে, মরেও শান্তি হবে না আমার। এ কথার সঙ্গে সঙ্গেই সেই অগ্নিবর্ষী চোখের কোলে বন্যা উঁকি মারে।
বেশ শুনব তোমার কথা। ইন্দ্রনাথ ননীর একচেটে সিংহাসন সেই প্যাকিং বাক্সটার ওপর বসে পড়ে বলে, এই বসছি। বলো, কী বলবার আছে!
.
আমার প্রথম কথাটাই আবার বলব, কেউ যদি বাঁচতে চায়, পৃথিবী তাকে বাঁচতে দেবে না?
তোমার কোন ইতিহাসই আমি জানি না কমলা।
আমারই কি সবটা জানা আছে? কমলা মাথা নিচু করে গাঢ়স্বরে বলে, শুনতে পাই ভদ্রঘরের মেয়ে ছিলাম, কেউ বা কারা ভুলিয়ে ধরে এনে বিক্রি করে দিয়েছিল এদের কাছে।–যাকে মাসি বলি সে আমার কেউ নয়।
ইন্দ্রনাথ বলে, আমারও ঠিক ওই কথাই মনে হচ্ছে কমলা। এরা তোমার আত্মীয় হতে পারে না।..কিন্তু বলছিলে–শুনতে পাও–কে বলেছে সে কথা?
মাসিরই বন্ধুরা। যখন ঝগড়া হয় এরা তো আর তখন কেউ কারুর বন্ধু থাকে না; গালমন্দ দেয়; বলে হাটে হাঁড়ি ভাঙব, তোর সব কথা বলে দেব। সেই ঝেকে বলে দিয়েছে আমায়। কিন্তু ওই মাসি বলে– সহসা চুপ করে যায় কমলা। বোধ করি শক্তি সংগ্রহ করতে থাকে বলবার জন্যে।
ইন্দ্রনাথ একটু চুপ করে থেকে বলে, কী বলে?
কমলা মুখ তুলে দৃঢ়গলায় বলে,-বলে যে, আমি তোকে খাইয়ে পরিচয় মানুষ করলাম তার শোধ দে।…বলে খারাপ হতে…। আমি তা পারব না…মরে গেলেও পারব না। উত্তেজিত স্বরে বলে কমলা–একদিন মরতেই গেলাম, কিন্তু ননীদা বলল– আবার থেমে গেল কমলা।
ননীদা কে? বিস্মিত কণ্ঠে উচ্চারণ করে ইন্দ্রনাথ।
ননীদা এমনি একটা ছেলে, কমলা ঢোক গিলে বলে, কাছেই কোথায় থাকে, ছেলেবেলা থেকে আমায় খুব স্নেহ করত। আগে ওই মোড়ে চায়ের দোকানে কাজ করত, আমাকে রাস্তায় দেখলেই বিস্কুট দিত। তারপর ও কী করে যেন ফটো তুলতে শিখল, ফটোর দোকানে চাকরি হল, ভদ্রলোকেদের সঙ্গে মিশে মিশে অনেক বুদ্ধি হল, ও তাই আমাকে পরামর্শ দিলে মাসির কথা শোনার থেকে অনেক ভাল কাজ লোক ঠকিয়ে খাওয়া!…বললে পৃথিবীসুদ্ধ লোকই তো লোক ঠকিয়ে খাচ্ছে! তাই–
কত বড় ছেলে তোমার ননীদা?
আমার থেকে ছসাত বছরের বড়।
ইন্দ্রনাথ সহসা একটু তীব্রস্বরে বলে ওঠে,–তা সে তো তোমাকে বিয়ে করলেই পারে?
কমলা বলতে পারত, হ্যাঁ তাই তো ঠিক হয়ে আছে, বলতে পারত–সেই আশায় তো দিন গুনছি, বলতে পারত–দিন না ওর অবস্থার একটু উন্নতি করে–কিন্তু বলতে পারল না। ইন্দ্রনাথের পিসিমার গাড়িতে বসে থাকা ননীর হিংসে কুটিল মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।
ওই নীচ ননীকে আর বিয়ে করতে পারবে না। ননী নিজের হাতে নিজের মূর্তি আছড়ে ভেঙেছে। নইলে ননীই কি কমলার আরাধ্য পুরুষ ছিল না এতদিন?
সত্যি বটে, বিগত কতকগুলো দিন ইন্দ্রনাথের মহিমা কমলার সমস্ত সত্তা, সমস্ত চেতনা, সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তি আচ্ছন্ন করে থাকলেও মনের মধ্যে ননীর কাছে একটা অপরাধ-বোধের ভারে পীড়িত হচ্ছিল, কিন্তু এ কী করলে ননী!….তার এতদিন ধরে আঁকা ছবিটার ওপর এমনি করে কালির পোঁচড়া বুলিয়ে দিলে!
.
ননীর সেই কালিমাখা ছবিটা স্মরণ করে কমলা মাথা নেড়ে ইন্দ্রনাথের কথার জবাব দেয়, না, তা পারে না। কারণ আমি করব না।
আমি করব না!
ইন্দ্রনাথ মিনিটখানেক স্তব্ধ থেকে বলে, কিন্তু কেন? ও তো তোমাকে স্নেহ করে! ও তোমার উপকার করেছে!