আমার মুখ চেয়ে, আর কেন!
তোর মুখ চেয়ে চেয়ে এতদিন গেল। বাসার সবাই আমার গালে মুখে চুন দিচ্ছে। বলে কুড়ি বছরের ধাড়ীকে তুই এখনো ভাতকাপড় দে পুষছিস কেষ্ট? বলি ওর একটা কর্তব্য নেই তোর প্রিতি?…বলবে নাই বা কেন? ক্ষীরির মেয়েটা তোর চাইতে কোন্ না পাঁচ বছরের ছোট, সে-ও তো কবে থেকে মায়ের হাতে ট্যাকা তুলে দিচ্ছে।
মাসি! কমলা ছলছল চোখে বলে, আমাকে দিয়েও তো টাকা হচ্ছে তোমার।
আরে বাবা সে হলোগে ঝুঁকির টাকা! সকল দায় আমি মাথায় করে, হাজার মিথ্যে কথা কয়ে…তবে না? বলতে গেলে ও ট্যাকা তো আমার উপার্জন!…ও আর আমার ভাল লাগে না–বড়লোকের দেউড়ি ডিঙোতে বুক কাঁপে। ছিঁড়ে ফেলে দিগে যা ফটো। আমি আজই সেই মেডো ছোঁড়ার সঙ্গে কথা কয়ে আসব। সে বলেছে বিয়ে করবে।
কমলার বুকটা ঢিপ ঢিপ করে ওঠে ভয়ংকর একটা ভয়ে। এ পল্লীতে বিয়ে বস্তুটা যে কী, তা আর তার জানতে বাকী নেই। তাই কাতরকণ্ঠে বলে, আর একবারের মতন দেখ মাসি!
না না। বলি আর একবারের মতন দেখলেই বা আমার কি ক্ষতি লাভ হবে? ওই ননে হারামজাদার সঙ্গে তোর বে দেব ভেবেছিস তুই?
বেশ বাপু, দিও না।
তাহলে? তাহলে কি ধর্মের ষাঁড় হয়ে থাকবি? তোর ওজর-আপত্তি আর শুনছিনে আমি।
হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠে কমলা। বলে, আমার অনিচ্ছেয় তুই আমায় দিয়ে যা খুশি করাতে পারিস ভেবেছিস?..পুলিসে গিয়ে যদি শরণ নিই, তোর কী দশা হবে জানিস?
কমলার দপ করে জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দপ্ করে নিভে যায় তার মাসি। আমতা আমতা করে বলে, তা বলবি বৈকি, এই তো কলির ধর্ম! বুড়ি মাসিকে পুলিসে ধরিয়ে দিয়ে ভাল প্রিতিদানই দিবি! হবে না কেন? কুবুদ্ধি তো হবেই, বুদ্ধিদাতা শনি যে জুটে বসে আছেন! সাধে কি আর ননেকে ঢুকতে দিতে চাইনে? বংশের ছেলে, এল গেল কি দুটো হাসি মশা করলো, তাতে কিছু বলতাম না। এ যে ক্রমশ আমার মটকায় আগুন লাগাচ্ছে। বলে কিনা পুলিসে খবর দেবো!…দে দে, তাই যদি তোর ধর্মে হয় তো দে! যা এখুনি যা, ডেকে আন পুলিস; হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাক পাড়ার বুকের ওপর দিয়ে।
কমলা হেসে ফেলে। দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলতে পারে সে, এই তার স্বভাব। হেসে বলে, এখুনি যাবো তা তো বলিনি। বেশি যদি জ্বালাতন করো তবেই।…কী দরকার আমাদের বেশি টাকায় মাসি?
আহা লো! ন্যাকা এলেন আমার! বলে ঝটকান মেরে চলে যায় কেষ্টমোহিনী। আর আশ্চর্যের বিষয়, কমলা সেই ছবিখানাই দেখতে থাকে আবার।
নিজেকে দেখতে এত ভাল লাগে কেন, কেন এমন নেশা লাগে? কেন দেখে দেখেও আশ মিটতে চায় না? কিন্তু শুধুই কি নিজেকে? আচ্ছা–এই ছবিটা মুছে ফেলে এখানে ননীর মুখটা সেঁটে দিলে কেমন হয়?… অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করলো কমলা নিজের সেই হাসি-ঢলঢল কনেসাজা মুখখানার পাশে ননীর মুখটা বসাতে। কিছুতেই মনে ধরাতে পারলো না।
ননীর মুখটা পৃথিবীর।
এ মুখটা আকাশের।
কিন্তু কমলার এই মুখখানা? এ মুখটা পৃথিবীর মাটির আদল ভুলে এমন আকাশের হয়ে উঠলো কোন মন্ত্রে?
.
নীহারকণা লেস বুনছিলেন। সায়ার লেস।
বিধবা নীহারকণা নিজে লেসদার সায়া পরেন না, বাড়িতে দ্বিতীয় আর মেয়েমানুষও নেই, তবু অবকাশ হলেই সায়ার লেস বোনেন তিনি। হা এই একটা বুনুনিই শিখেছিলেন নীহারকণা, কবে যেন কার কাছে, আর তদবধি তিনি অবিরত এই একটি কাজ করে চলেছেন, ভাল ভাল রেশমী সুতো আনিয়ে। আর মাদুর গোটানোর মত করে গুটিয়ে গুটিয়ে বাক্স ভরতি করে জমিয়ে তুলছেন সেই লেসের পাহাড়।
কেন? বিরাট এক আশার পাহাড় গড়া আছে যে নীহারকণার মনের মধ্যে।
ফুটফুটে সুন্দর একটি বৌ আসবে এ ঘরে, সব সময় শুধু সেজেগুজে হেসেখেলে বেড়াবে। সে, আর নীহারকণা তার জন্যে রাশি রাশি লেস-বসানো সায়া তৈরি করবেন। কেনা জিনিস দিয়ে বাক্স ভরানো যায়, মন ভরানো যায় কি?
কিন্তু কোথায় সেই বৌ? বৌ আসার আশা ক্রমশই যেন ঝাপ্সা হয়ে আসছে। যাকে নিয়ে বৌ আনার স্বপ্নসাধ, নীহারকণার এই সাধে সে বাদ সাধছে। বিয়ে করতে আদৌ রাজী নয় সে।
আর যতই সে তার প্রতিজ্ঞায় অটল হয়, ততই নীহারকণা চোখ ঠিকরে লেস বোনেন।
.
আজও সেই লেস বুনছিলেন।
চাকর জগবন্ধু এসে দাঁড়ালো, পিসিমা!
নীহারকণা চোখ না তুলেই বললেন, কেন, কী দরকার?
দুটো মেয়েছেলে আপনার খোঁজ করছে।
মেয়েছেলে!
নীহারকণার একাগ্রতা ভঙ্গ হলো, কী রকম মেয়েছেলে?
মানে আর কি…ইয়ে মতন।
জগবন্ধু বোধ করি যাচ্ছিল ঘর মুছতে, হাতে জলের বালতি। মুখটা বেজার বেজার। সেই বেজার মুখটা আরও বেজার করে বলে, এই যারা সব ভিক্ষে সাহায্য চাইতে আসে, তেমনি ধারা। একটা গিন্নীমতন, একটা কমবয়সী।
নীহারকণা বিরক্তভাবে বললেন, তবে আবার ঘটা করে বলতে এসেছিস কেন? ভাগাতে পারিসনি?
বললো সাহায্য চায় না, শুধু দেখা করতে চায়।
সাহায্য চায় না। শুধু দেখা করতে চায়!-কেন?
নীহারকণা ভুরু কুঁচকে বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলেন, শুধু দেখা করে আবার তার কি চতুর্বর্গ লাভ হবে? কই কোথায় তারা?
জগ হাতের জলের বালতিটা দুম করে নামিয়ে গম্ভীর চালে বলে, ওই যে মাঝ-সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আপনাকে না বলে তো আর হুট করে কাউকে ওপরে তুলতে পারিনে পিসিমা।
পারিসনে বুঝি? তবু ভাল! নীহারকণা বলেন, তাহলে তো দেখছি আশী বছর না হতেই সাবালক হয়ে গেছিস তুই! নে ডাক দিকি, কাকে কোথায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস! সাহায্য চায় না, শুধু দেখা করবে? হুঁ! ও আর এক রকম চালাকি, বুঝলি? অনেক বাড়িতে তো সাহায্য চাইলে দেখাই করে না কিনা! ওই যে বলছিস সঙ্গে কমবয়সী মেয়ে রয়েছে, নিশ্চয় ওই মেয়ের বিয়ের ছুতো করে টাকা চাইবে!