সামনে দিয়ে গাড়িটা চলে যায়, আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন নীহারকণা আর চন্দ্রনাথ। একটু পরে একটা নিশ্বাস ফেলে চন্দ্রনাথ বলেন, উঠে এসো দিদি। মনে হচ্ছে বারে বারে আমাদেরই ভুল হচ্ছে!
ভুল হচ্ছে? নীহারকণা ক্রন্দনজড়িত স্বরে বলেন, ভুল হচ্ছে আমার? আমি তোকে স্ট্যাম্পো কাগজে লিখে দিতে পারি চন্দর, এ মেয়ে সেই মেয়ে! ও যতই নাম বদলাক আর ভোল বদলাক, হাজারটা মেয়ের থেকে একনজরে চিনে বার করতে পারব আমি ওকে! ওর ছবি আমার বুকের মধ্যে খোদাই করা হয়ে আছে!
তাহলে তোমার এই কি বলে, ননী বলে ছেলেটা সরে পড়ল কেন?
নীহারকণা সনিশ্বাসে বলেন, সেই তো রহস্য!
.
কিছুক্ষণ পাতালপুরীর স্তব্ধতা।
তারপর এক সময় ফের নীহারকণাই বলেন, আসল কথা বুঝছি, বিয়েই করেছে। নইলে অত বুকে জোর? লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, করলি করলি–একটা অঘরে কুঘরে বিয়ে করলি! আর সেই নিয়ে এমন ডুবলি যে আমাদের চিনতে পারছিস না! চন্দর, তুই কালই আমায় হরিদ্বারে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর! গুরু-আশ্রমে উঠোন ঝেটিয়ে বাসন মেজে খাব, তাও আমার মান্যের!
এতক্ষণ পরে চন্দ্রনাথ একটু হাসেন। ক্ষোভের, দুঃখের, তিক্ত ব্যঙ্গের–তুমি তো সুখী দিদি, তোমার তো তবু গুরু-আশ্রম আছে, মানের জায়গা আছে, ইচ্ছে হলেই চলে যেতে পারো সেখানে!
.
কৃষ্ণমোহিনী গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা একি! কী ব্যাপার বাছা? মেয়েকে আমার কোথায় নে গিয়েছিলে যে, এমন অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে এসে পড়ল?
ইন্দ্রনাথ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। ইনিই কমলার মাসি নাকি? .
কমলাকে দরজার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে গেছে ইন্দ্রনাথ অনেকদিন, বেড়ার এই দরজাটার বাইরের পিঠটা তার চেনা, এ পিঠটা কোনদিন দেখেনি। কমলাও অনুরোধ করেনি কোনদিন, বরং ইন্দ্রনাথকে মোড়ের মাথা থেকে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টাতেই তৎপরতা তার।
আর আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, ওই তো আমাদের বাড়ি, এবার ঠিক চলে যাব–এই ছিল তার বুলি।
ইন্দ্রনাথ ভাবত দারিদ্র্যের লজ্জা। কিন্তু কৃষ্ণমোহিনীকে দেখেই তার বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।
এ কি কোন ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর? আর মুখ? মুখের চেহারাতেও যেন স্পষ্ট ফুটে রয়েছে একটা কুৎসিত জীবনের গ্লানিকর ছাপ।
তবু ইন্দ্রনাথকে তো ভদ্রতা রাখতেই হবে। তাই মৃদুস্বরে বলে, গিয়েছিলেন আমাদের একটা স্কুল দেখতে উত্তর কলকাতায়। বোধহয় বেশী গরমে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। অন্যত্র নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতে গেলে দেরি হবে, আপনি চিন্তিত হবেন, তাই এখানেই নিয়ে এলাম।
তা তো এলে। কিন্তু ইস্কুল দেখাতে নিয়ে যাবার হুকুমটা কে দিয়েছিল বাছা? আমার এই ভরা বয়সের মেয়েকে যে তুমি কোথায় না কোথায় নিয়ে বেড়াও, সেটাই কি ভাল কর? তারপর আজ এই কোথায় নিয়ে গিয়ে এই অবস্থা করে আনলে–কী জানি কী করেছ! বড়লোক বলে কি গরিবের মান-ইজ্জত রাখবে না? আমি যদি এখন লোক ডাকি! পুলিসে দিই তোমায়?
হ্যাঁ, কৃষ্ণমোহিনী আজ ইন্দ্রনাথের সম্বন্ধে একটা হেস্তনেস্ত করতে বদ্ধপরিকর। ওর জন্যেই তার ব্যবসাপত্র লাটে উঠতে বসেছে।
হঠাৎ ইন্দ্রনাথের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বিদ্যুৎ-শিহরণ খেলে যায়।…তবে কি পিসিমার কথাই সত্যি? এ সবই ষড়যন্ত্র?…নইলে এ কি? এ কি জঘন্য কুৎসিত ভাষা আর ভঙ্গি!…
তবু নিজেকে প্রাণপণে সংযত রেখে ইন্দ্রনাথ বলে, লোক ডেকে আমাকে পুলিসে ধরিয়ে দেওয়ার চাইতে অনেক দরকারি কাজ হবে ডাক্তার ডেকে এঁর চিকিৎসা করান।
ডাক্তারের খরচাটা তাহলে তুমিই দাও বাছা! দয়ার শরীর, পয়সা আছে, দেবে না কেন?
হয়তো ইন্দ্রনাথ নিজেই ডাক্তার ডাকতে যেত, কিন্তু নীচ এই কথার পর তার সমস্ত অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দৃঢ়স্বরে বলে, না, তা দেব কেন? আপনাদের মেয়ে আপনিই দেবেন। অবশ্য আপনি যদি সত্যিই এঁর আত্মীয় হন!
কেন, অবিশ্বাস হচ্ছে বুঝি? কেষ্টমোহিনী মুখ সিটকে বলে, তা হবে বৈকি। আমি যে কাঙাল! এই কমলি, আর কতক্ষণ ভেক ধরে থাকবি? চোখ মেলে বুঝিয়ে দে না বাবুকে, আমি তোর সত্যি মাসি হই, না তুই রাজকন্যে, আমি খুঁটেকুড়নি!
মির্জাপুর থেকে যাদবপুর কম রাস্তা নয়। চলন্ত গাড়ির উদ্দাম হাওয়ায় অনেকক্ষণ আগেই আকস্মিক লুপ্ত হয়ে যাওয়া চেতনা ফিরে এসেছিল কমলার। কিন্তু নিদারুণ একটা আতঙ্কে আর আশঙ্কায় চোখ খুলতে পারছিল না। নির্জীবের মত চুপ করে চোখ বুজে পড়েছিল।
না, কিছুতেই ইন্দ্রনাথের সামনে চোখ খুলতে পারবে না কমলা, পারবে না মুখ দেখাতে। ও আগে চলে যাক।চোখ বুজে কল্পনা করছিল যদি এ অজ্ঞানতা না ভাঙত!
কিন্তু আর পারল না নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুজে থাকতে। মাসির আক্রোশ যে কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, সে সম্বন্ধে ধারণা আছে যে কমলার। তাই ধীরে চোখ খুলে হাতের ইশারায় কেষ্টমোহিনীকে চলে যেতে বলে।
অ! চলে যাব? তা যাচ্ছি। নাগিনী শেষ ছোবল মেরে যায়, কিন্তু এই পষ্টকথা বলে দিচ্ছি কমলি, তেমন বুঝলে আমিও ছেড়ে কথা কইব না!
কী বুঝলে কী ছাড়বে না, সেটা উহ্য থাকে।
কেষ্টমোহিনী চলে যেতেই ইন্দ্রনাথ কমলার কুশল প্রশ্নের পরিবর্তে জলদগম্ভীর স্বরে বলে,-যাক, জ্ঞান ফিরে এসেছে তাহলে? আশা করি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে!..আমি শুধু জানতে চাই, তুমি আমার পিসিমাকে এর আগে কোনদিন দেখেছ?