ইন্দ্র কি বুঝছে, নিজেকেই নিজে ঠকাচ্ছে? বুঝছে কি কমলাকে এই কাজ দেওয়ার আকুলতা, তাকে আরও বারবার দেখতে পাবার, বেশি করে কাছে পাবার অবচেতন বাসনা! …না, ইন্দ্রনাথ সেকথা বুঝছে না। এমন অবস্থায় কেউই বোঝে না।
তোমাকে অবশ্য আমি একেবারে অমনি খাটাব না। ইন্দ্র হাসে। আগের কথার জের টেনেই বলে, তোমার সময়ের বিনিময়ে সরে ফান্ড থেকে সামান্য কিছু পাবে। তবে সে সামান্যটা যৎসামান্যই। জানোই তো, এসব সঙ্-টঙ্র ফান্ড কত কাহিল হয়!
কমলা মুখ তুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আমি আপনার কিছু কাজ করতে পেলেই ধন্য হয়ে যাব। আর কিছুই চাই না।
ইন্দ্রনাথ কী উত্তর দিত কে জানে, হঠাৎ কেমন একটা হৈ-হৈ উঠল, কানের উপর এসে আছড়ে পড়ল যেন অতি পরিচিত কোন কণ্ঠস্বর, সঙ্গে সঙ্গে ঘঁাচ করে থেমে গেল গাড়িখানা।
ওঃ, শুধু এ গাড়িখানা নয়, পাশে আরও একখানা গাড়ি আচমকা থেমে গেছে।…ধাক্কা লাগছিল নাকি?
ধাক্কা লাগত নয়, লেগেছে। গাড়িতে গাড়িতে নয়, ধাক্কা লেগেছে ইন্দ্রনাথের বুকে… ধাক্কা লেগেছে তার চোখে। তাই হঠাৎ থেমে যাওয়া সেই মূল্যবান প্রাইভেট কারখানার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে ইন্দ্রনাথ।…কিন্তু সে আর কতক্ষণের জন্যে! বড় জোর এক পলক!
নীহারকণা নেমে পড়েছেন পথের ওপর। সমস্ত রাস্তা সচকিত করে তার আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছে, ও চন্দর, এই তো সেই সর্বনাশী!
কী ব্যাপার? ইন্দ্ৰনাথ উদ্ভ্রান্তের মত গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
কিন্তু কমলা? কমলা কি বেঁচে আছে?
কাকে কী বলছ পিসিমা? এ হচ্ছে কমলা, আমাদের সঙ্ঘের একটি সদস্য। ইন্দ্রনাথ বলে।
রেখে দে তোর সদস্য। কমলা কেন…ওর আরও ঢের নাম আছে। কাকে কী বলছি? ঠিকই বলছি। ছলাকলা-উলি ডাইনীকে যা বলবার বলছি।…এই তো সেই অরুণা। যে সেদিন মা নিয়ে ছেলে নিয়ে বাড়ি বয়ে গিয়ে আমার সর্বনাশ করে এল! আমার সোনার চাঁদকে ঘরছাড়া করল। এখনো আমাকে পথে পথে ঘোরাচ্ছে!…বাঃ, এখন যে আবার সিঁদুর মুছে ডবল বিনুনি ঝুলিয়েছ দেখছি! তাই তো বলি, এতবড় ঘোড়ড়ল মেয়ে না হলে আমার চোখে ধুলো দিয়েছে, আবার আমার ইন্দুর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে…
পিসিমা! ধমকে ওঠে ইন্দ্রনাথ, রাস্তায় আর একটি কথা নয়! এমন পাগলের মত কথা বলছ যে তোমার মাথায় বরফ চাপানো উচিত! বাবা আপনিও তো রয়েছেন, অথচ
নীহারকণা চেঁচিয়ে ওঠেন, ওর আবার থাকা-না-থাকা! ও যদি মানুষ হত, তাহলে কি আর এই এতদিন তোকে আমি ওই ডাইনীর কবলে ফেলে রাখতাম! ভাগ্যিস যাই এই ভালমানুষের ছেলেটি গিয়ে আমায় সন্ধান দিল! বল না গো বাছা!
গাড়ির মধ্যে পাথরের পুতুলের মত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ননীর দিকে দৃষ্টিপাত করেন নীহারকণা।
কিন্তু ননীই কি বেঁচে আছে? ট্যাক্সির মধ্যে সীটের কোণে জড়ে বসে থাকা কমলার পাংশু মুখখানা দেখেই সমস্ত চৈতন্য লুপ্ত হয়ে গেছে। ওই মুখ দেখামাত্রই অনুভব করতে পারছে ননী কী কাজ করেছে সে! কী ভয়ংকর গর্হিত! কী গহিত, কী নীচ, কী ছোট।
ঈর্ষার জ্বালায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। সহ্য করতে পারছিল না কমলা আর ইন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব। কিন্তু এত কৌশল করে, এত দুঃসাহস করে ইন্দ্রনাথের চোখ থেকে কমলাকে সরিয়ে ফেলে লাভই বা কী হবে ননীর? কমলা কি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে ননীকে?
ট্যাক্সি ড্রাইভারটা প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিল, এখন গজগজ করে উঠল–সে গাড়ি চালাতে বেরিয়েছে, তামাশা দেখবার সময় তার নেই। বাবু তাকে ছেড়ে দিক! ·
আচ্ছা ঠিক আছে। ছেড়ে দিচ্ছি তোমায়। ইন্দ্রনাথ বলে, চলো পিসিমা বাড়িতেই চলো। তোমাদের কতকগুলো ভুল ভাঙুক। কমলা নেমে এসো তো। এ গাড়িতে উঠে এস। দেখ এই হচ্ছেন আমার পিসিমা, আর এই আমার বাবা। মিথ্যে একটা ভুল করে ওঁরা তোমায় অপমান করে বসেছেন, তার জন্যে আমি ওঁদের হয়ে মাপ চাইছি। এস নেমে এস।
কিন্তু নেমে আসবে কে? নেমে আসবার ক্ষমতা কি কমলার আছে? ওই গাড়িতে ননীকে দেখেই সমস্ত ঘটনাটা জলের মত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তার চোখে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সমস্ত পৃথিবী।
কর্মলা! কমলা!কমলা! ঝুঁকে পড়ে ডাক দেয় ইন্দ্রনাথ। বিব্রত বিপর্যস্ত বেচারী ইন্দ্রনাথ। মেয়েটা এত সুকুমার! পিসিমা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কী বললেন আর ও এমন হয়ে গেল!
পিসিমার বলার ধরনটাও কী কুৎসিত, অপমানকর! এতখানি বয়সে প্রথম এই মনে হল ইন্দ্রনাথের, নীহারকণা কী অমার্জিত, কী গ্রাম্য, কী অভদ্র।
চন্দ্রনাথ এবার গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন। উদ্বিগ্নভাবে বলেন, কী, হল কী?
হবে আবার কী? পিসিমা চাপা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, বুঝতে পারছিস না? হাতে-নাতে ধরা পড়ে গিয়ে এখন ভয়ে লজ্জায় মুচ্ছো যাওয়ার ভান করছেন। যে মেয়ে অতবড় থিয়েটার করে বেড়ায়, তার কাছে আর এ কতটুকু?…ওরে ইন্দু, অমন আগুনজ্বালা চোখে আমার দিকে তাকাবার আগে এই ভালমানুষের ছেলের কাছে শোন্ ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়ের ইতিবৃত্ত! বলো না গো বাছা–ওমা একি! গেল কোথায় ছোঁড়া?
হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন নীহারকণা। এঁদের গোলমালের মাঝখানে নিঃশব্দে কখন চলে গেছে ননী।
বাঃ, চমৎকার! তোমার বিশ্বস্ত সংবাদদাতা একেবারে হাওয়া! নীহারকণার দিকে একটা ব্যঙ্গদৃষ্টি হেনে ইন্দ্রনাথ সহসা একটা কাজ করে বসে। ট্যাক্সিটায় চড়ে বসে সশব্দে তার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলে, এই ট্যাক্সি, চলো যাদবপুর!