আজ মনে হচ্ছে ঠাকুর আছেন। হা হা, ঠাকুর আছেন। তাই সেদিন ইন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে ইন্দ্রনাথের মুখোমুখি পড়তে হয়নি। পড়লে কোথায় থাকত এই স্বর্গ!
হাসি শুনে ইন্দ্র যেন চমকে উঠল। এ মেয়ে এমন করে হাসতেও জানে? এযাবৎ শুধু দেখে এসেছে ওর কুণ্ঠিত লজ্জিত নতমূর্তি!
ক্ষণিকের এই উচ্ছ্বসিত হাসিতে ওর যেন আর একটা দিক খুলে গেল। সেদিকটা শুধুই একটি অভাবগ্রস্ত ঘরের সাহায্যপ্রার্থী ম্রিয়মাণ মেয়ে নয়, একটি প্রাণোচ্ছল তরুণী মেয়ে। যে মেয়ে হয়তো সত্যকার একটা মানুষের জীবন পেলে এমনি হাসিই জীবনভোর হাসতে পারবে।
লেখাপড়ায় ত্রুটি আছে। কিন্তু সে ত্রুটি তো নিতান্তই বহিরঙ্গ। ওর ভিতরের ওই বুদ্ধি আর নিষ্ঠার সঙ্গে যদি টিউটরের চেষ্টা যুক্ত করা যায়, সে ত্রুটি পূরণ হতে কতক্ষণ?
মুহূর্তের চিন্তা মুহূর্তেই লয় পেল। লজ্জিত হল ইন্দ্রনাথ নিজের কাছেই। তারপর হেসে তাড়াতাড়ি বলল, কার মধ্যে যে কতটা সম্ভাবনা আছে, সে কথা আগে থেকে বোঝ শক্ত। উপযুক্ত ক্ষেত্রে এসে পড়লে তবে যোগ্যতা অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। এই ধরুন না কেন, আমি যদি আপনাকে এরকম কোন স্কুলে নিচুদিকের দুএকটা ক্লাসের ভার দিই, তাহলে আপনি হয়তো কোন গ্র্যাজুয়েট মেয়ের চাইতে কিছু কম করবেন না। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই।
ক্লাসের ভার? মানে পড়ানোর ভার? আর একবার তেমনি করে হেসে ওঠে কমলা। ওর বুঝি এই হাসির নেশা লেগেছে।
ইন্দ্রনাথ যেন চোখ ফেরাতে ভুলে যায়।
হাসতে হাসতে লালচে মুখে বলে কমলা, আমার সামনে বললেন বললেন, আর কারো সামনে যেন বলে বসবেন না! তবে হ্যাঁ, ক্লাস ঝাড় দেবার কাজটা যদি আমাকে দেন, তাহলে হয়তো সার্টিফিকেট পেতেও পারি।
ইন্দ্রনাথও হেসে উঠে বলে, তাহলে প্রথম নম্বর তাতিনী, দ্বিতীয় নম্বর ঝাড়দারনী—
দুজনের হাসি এক হয়ে বাজতে থাকে।
চলুন, যাওয়া যাক! বাসের রাস্তার দিকে এগোতে থাকে ইন্দ্রনাথ। এখন আর তার গাড়ি নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাও ছাড়তে হয়েছে।
মধ্য কলিকাতা সমাজকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়-এর মধ্যেকার অবস্থাটা খুব এমন উৎসাহকর নয়। তবু কমলাকে এনে অনেক উৎসাহে অনেক আশার কথা বলতে থাকে ইন্দ্রনাথ। আর সেই বহু কথা বলার মধ্যে যে কখন আপনি থেকে তুমি হয়ে গেছে, সেকথা নিজেই টের পায় না ইন্দ্রনাথ।
সেই কথাই বলছি কমলা,–এইটুকু ঘর, কটিই বা ছেলেকে বসতে দেওয়া যায়। প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। মরুভূমিতে বিন্দুজল। তবু আমি হতাশ হই না। বুঝলে কমলা, চিরকালের যে প্রবাদ আছে, বিন্দু থেকে সিন্ধু–সে কথায় আমি বিশ্বাসী। আমি কল্পনা করি
আমার সেই দেশের ছবি, যেখানে কেউ নিরক্ষর নেই, কেউ দরিদ্র নেই…।
কমলাকে বুঝি আজ হাসিতে পেয়েছে, তাই আবার হেসে উঠে ইন্দ্রনাথের সুরে বলে–কেউ চোর নেই, কেউ ডাকাত নেই!
না, চোর-ডাকাতটা থাকা দরকার। উচ্ছ্বসিত কৌতুকে হাসতে থাকে ইন্দ্রনাথ, চোর ডাকাত কিছু কিছু চাই। সর্বদা হারাই হারাই ভাব না থাকলে আর মজা কী!
এখন পড়ন্ত বিকেল, বিদ্যালয়ের বিদ্যাধারা নেই। দুএকজন শিক্ষিকা, একজন কেরানী, চাকরটা, দারোয়ানটা এদিক ওদিক ঘুরছে, তারা সেক্রেটারির এহেন কৌতুক-হাসির শব্দ শুনে একটু চকিত হল। প্রাণখোলা হাসি হাসে বটে ইন্দ্রনাথ, কিন্তু এরকম একক কোন তরুণী সঙ্গে করে নয়।
স্কুলবাড়ি থেকে বেরিয়ে ইন্দ্রনাথ বলল, উঃ কী ভীড়, বাসে চড়তে পারার আশা রাখেন? যাত্রীদের অবস্থা দেখুন!
আবার আপনি? বাঃ! কমলা একটু অভিমানের সুরে বলে।
আবার মানে? ইন্দ্রনাথ অবাক হয়ে তাকালো।
এতক্ষণ তো তুমি বললেন!
বললাম নাকি? ও হো হো কিছু মনে করবেন না, আমি ওইরকম অন্যমনস্ক।
মনে করব, যদি আবার আপনি চালান!
ইন্দ্রনাথ ওর মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে বলে, তুমি বললে খুশী হও?
কমলা মাথা নিচু করে। না, এ দৃষ্টির দিকে তাকাবার ক্ষমতা তার নেই।
কই, বললে না?
হই।
আচ্ছা! একটা ট্যাক্সিই নেওয়া যাক, কী বল?
ট্যাক্সি! মুহূর্তের জন্য একবার কেঁপে ওঠে কমলা। কেন? এ প্রস্তাব কেন? কী মতলব? তবে কি তবে কি ননীদার সন্দেহই ঠিক–এসব বড় লোকের ছেলেরা সুন্দরী মেয়ে দেখলেই জ্ঞান হারায়!
পরক্ষণেই নিজের মনে নিজেকে ছি ছি করে ওঠে কমলা। ছি ছি, কী তার পাপের মন!
ইন্দ্রনাথ ওর বিমনা ভাব লক্ষ্য করল। কী ভেবে বলল, তবে থাক, বাসেই যাওয়া যাক তেঁতুলগাছে বাদুড় ঝুলে!
কমলা লজ্জা ঢাকতে তাড়াতাড়ি বলে, কেন, কী হল? আমার তো শুনে বেশ মজাই লাগছিল।
মজা!
হ্যাঁ! কমলা স্থিরস্বরে বলে, গাড়ি চড়বার ভাগ্য আর আমাদের জীবনে কবে আসে বলুন? না না, ভয় করবে না কমলা, কিছুতেই না। ভয় করে নীচ হবে না, ছোট হবে না।
ট্যাক্সিতে চড়ে বসে ইন্দ্রনাথ আগের কথার জের টানে, সত্যি কমলা, নাও না আমার স্কুলের কিছু ভার। তাহলে আমি আরও ছেলেমেয়ে নিতে পারি।
কমলা এবার গম্ভীর হল। গম্ভীরভাবে বলল, আমাকে আপনি কী একখানা ভাবেন বলুন তো! মস্ত একটি বিদুষী?
না কমলা। মস্ত একটি বিদুষী তোমায় ভাবি না, কিন্তু মস্ত একটা সম্ভাবনা যেন দেখতে পাই তোমার মধ্যে। কিন্তু সে কথা থাক। আমার তো খুব একটা বিদুষীর প্রয়োজন নেই–পড়াতে হবে তো বর্ণপরিচয়, এটুকু তুমি নিশ্চয় পারবে।