নাঃ, কমলার আর সে এনার্জি নেই। ননীর অবস্থা দেখে তার দুঃখ হচ্ছে, মমতা হচ্ছে, বুঝি বা করুণাও হচ্ছে, কিন্তু তার জন্যে কিছু করবার উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছে না কমলা।
উৎসাহ কমলা কিছুতেই পাচ্ছে না। তাই বসে বসে ননীর ওপর রাগ আনতে চেষ্টা করে। আচ্ছা কেন–কেন ননী এভাবে অপমান করবে কমলাকে? শুধু কমলাকেই নয়, সেই দেবতুল্য মানুষটাকেও! ছি ছি ছি!
যেদিন থেকে তাদের স্কুলে ভরতি হয়েছে কমলা, সেইদিন থেকেই মুখ ভার ননীর। তারপর ক্রমশই মনের কালি ছড়াচ্ছে। ছুতোয়নাতায় ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে কমলাকে, আজ তো একেবারে চরম হয়ে গেল।
সন্দেহের কীট কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। অথচ সমস্তই অমূলক। সমস্তই হাস্যকর ধৃষ্টতা।
সঙ্ঘ-সেক্রেটারি ইন্দ্রনাথ চৌধুরী, রাজপুত্রের মত যার রূপ, রাজপ্রাসাদের মত যার বাড়ি, চারটে ছটা পাস করে একটা অফিসের সাহেব হয়ে বসেছে যে লোক, তার কাছে কিনা কমলা! কী ধৃষ্টতা!
কমলাকে তিনি পৌঁছে দিয়ে যান সত্যি, কিন্তু সে তো দয়া করে। কমলা কমবয়সী বলেই। ওই তঁতঘরে কমলার মতন মেয়ে আর কটা আছে? একটাও তো না! সবাই বড় বড়। সবাই প্রায় কালো কুশ্রী। তবে?
এটুকু যদি তিনি করে থাকেন কমলার জন্যে, সে তার দয়ালু স্বভাব বলেই। সূর্যের আলো পথের ধুলোর ওপরও পড়ে, কিন্তু পথের ধুলো কি সূর্যের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারে? কমলা ধুলো, একেবারে পথের ধুলো। তবু কমলাকে তিনি আপনি বলে কথা কন। কী অসহ্য সুখ!
সে যেন আর কেউ আর কোনো কমলা, অথবা সেইটাই সত্যিকার কমলা। আর এই নীচ সংসর্গে পালিত, এই হীন পরিবেশে পড়ে থাকা, এই চোর জোচ্চোর ধাপ্পাবাজ কমলা সেই কমলার একটা ছাউনি!…উপরকার খোলস একখানা!
তাই! তাই! এই খোলসখানা ভেঙে সত্যিকার কমলা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে তখন, যখন তার উপর সূর্যের কিরণ এসে পড়ে।
ননীদা এই ফুটে ওঠার মর্ম কি বুঝবে?
ওদের মগজে একটা মাত্র কথাই ঢোকে, সেটা হচ্ছে বিয়ে।
বিয়ে! এমন অসম্ভব সৃষ্টিছাড়া কথা মাথাতেও আসে ননীদার।
কিন্তু হঠাৎ নিজের মধ্যেই নিজে স্তব্ধ হয়ে যায় কমলা। বিয়েটা তাহলে কাকে? ননীদাকে? পাল্লাটা যে একেবারে হালকা হয়ে ঠক করে উঠে পড়ছে!
.
কিন্তু শুধু তো একা ননীই নয়, সঙ্রে অনেক সভ্য-সভ্যারই নজর লেগেছে কমলার এই সামান্য সম্পদটুকুর ওপর। ইন্দ্রনাথের আড়ালে হাসাহাসি করছে ওরা, সঙ্ঘের এবার বারোটা বাজল হে! ইন্দ্রনাথবাবুই যখন
যাই বল, ইন্দ্রদার পক্ষে এটা যেন ভাবাই যায় না।
বুঝলাম না হয় দেখতে শুনতে একটু পরিষ্কার, কিন্তু পরিষ্কার মুখ কি এর আগে কখনো দেখেননি ইন্দ্রদা? কত কত রূপবতী যে তার জন্যে তপ্যসা করছে!
বাবা ভীষ্ম হওয়া অত সহজ নয়! মনে হত কতই বুঝি একেবারে ইয়ে–যেই একটি সুন্দরী তরুণী দেখলেন, ব্যস্!
প্রায়ই চলেছে এ রকম আলোচনা।
.
কিন্তু ইন্দ্রনাথ কি খুব একটা কিছু অশোভন আচরণ করছে? না, সেকথা বললে তাকে অন্যায় দোষ দেওয়া হয়। সেসব কিছুই না।
শুধু কমলাকে দেখলেই ওর মুখটা কেমন একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কমলার সঙ্গে দেখা হবার ইচ্ছেয় অন্য সব কাজ তাড়াতাড়ি সেরে নিতে ইচ্ছে করে, কমলার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সময়ের জ্ঞানটা যেন একটু কমে যায়। আর কমলাকে তাদের সমস্ত কেন্দ্রের সমস্ত কাজকর্ম দেখিয়ে বেড়ানোটা একটা কর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে ইন্দ্রনাথ।
আজও সেই কথাই হচ্ছিল। মধ্য কলকাতায় আমরা আর একটা প্রাথমিক স্কুল খুলেছি, চলুন না দেখে আসবেন।
মধ্য কলকাতা! কোথায়! মানে কোন রাস্তায়? বিহ্বলভাবে বলে কমলা। কমলা কি জানে কাকে বলে মধ্য কলকাতা, আর কাকে বলে উত্তর!
মির্জাপুর স্ট্রীটের একটু ওদিকে। আশপাশে অনেক বস্তি রয়েছে–কত যে দুঃস্থ ছেলেমেয়ে তার সংখ্যা নেই। অবিশ্যি কিছুই হয় না, বুঝলেন, কিছুই হয় না–আবেগভরা কণ্ঠে বলে ইন্দ্রনাথ। একটা কেন এক হাজারটা প্রাথমিক স্কুল খুললেও এদেশের নিরক্ষরতা দূর হবে না, তবু চেষ্টা তো করতে হবে, কী বলেন?
কী বলেন! কমলাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কী বলেন? কী অভিমত তার? কমলার দীর্ঘ সুঠাম ঋজু দেহখানা বাতাসে বেতপাতার মত কাঁপতে থাকে।
কই কথা বলছেন না যে?
আমি কী বলব! অতি কষ্টে বলে কমলা।
আপনারাই তো বলবেন। কেবলমাত্র সুবিধের অভাবে উপযুক্ত শিক্ষার্জন করতে না পারার দুঃখ তো আপনারাই মর্মে মর্মে বোঝেন। দেখছি তো আপনাকে–কত বুদ্ধি, কত চেষ্টা, কি রকম অনলস পরিশ্রমী,-সুযোগ পেলে আপনি লেখাপড়ায় কত উন্নতি করতে পারতেন। হয়তো খুব ভাল একটি অধ্যাপিকা হতে পারতেন আপনি!
হয়তো পারতাম। কিন্তু সে তো আর এ জন্মে হল না! কমলা হঠাৎ সকৌতুকে হেসে ওঠে, তার বদলে না হয় একটি ভাল তাতিনীই হব! এ হাসি আচমকা। ইন্দ্রনাথের এই অগাধ আশার স্বপ্নবার্তা শুনে বুকের ভিতর থেকে নির্মল কৌতুকের হাসি উথলে উঠেছে কমলার।
সেই কমলা! খারাপ মেয়েদের কাছ থেকে বাচ্চা ছেলে ভাড়া করে এনে লোককে মিথ্যে দুর্নামের ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে টাকা আদায় করে পেট চালায় যে কমলা!
না, সেই থেকে অবিশ্যি আর কোনদিন সে-কাজ করেনি কমলা, কিছুতেই রাজী হয়নি করতে, কিন্তু এই সেদিনও তো করে এসেছে। তার সামনের এই জ্যোতির্ময় পুরুষটির নামেই তো কালি মাখিয়ে এসেছে সেদিন! উঃ, ভাগ্যিস ইনি সেদিন বাড়ি ছিলেন না! থাকলে তো কেষ্টমোহিনীর নির্দেশ আর ননীদার পদ্ধতি অনুযায়ী এঁর মুখের উপরই বলতে হত, এত নিষ্ঠুরই কি হতে হয়? বলতে হত, আমাকে দেখ না দেখ, এই দুধের শিশুটার মুখপানে চাও! বলতে হত, তা এখন তো চিনতে পারবেই না! কিন্তু ধর্ম আছেন, ঠাকুর আছেন। এই বাচ্চার দিকে তাকিয়ে… তারপর আর কথা শেষ করতে হত না, শুধু কাঁদলেই চলত।