এতে আবার মানুষ বিভ্রান্ত না হয়ে পারে?
কিন্তু এখন এ চোখে আর কিছু নেই, আছে শুধু মুগ্ধ বিনম্র চিত্তের পূজা।
কৃতজ্ঞ দৃষ্টি ঢের দেখেছে ইন্দ্রনাথ, তবু যেন কেমন চাঞ্চল্য জাগে। তাড়াতাড়ি চলার গতি দ্রুত করে ফেলে বলে, একটু শীগগির চলুন, স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে মুশকিল!
ননী এসে আগের মত চৌকির ওপর বসে পড়ল না, বসল প্যাকিং কাঠের টেবিলটার ওপর। আজ আর তার শ্যামল মুখে আলোর উপস্থিতি নেই। কালো শুকনো শীর্ণ মুখ, চোখদুটো যেন দপদপ করছে। মুখের রেখায় রেখায় ঈর্ষা আর হতাশা, ক্লান্তি আর রুক্ষতার ছাপ।
এখন আর আগের মতন উফুল্ল আনন্দে হাসতে হাসতে ঢোকে না ননী, এবং সহজ আনন্দে সে আবির্ভাবকে বরণ করতে পারে না কমলা। কমলা যেন লজ্জায় আড়ষ্ট, ননী বিস্ময়ে কঠিন। কমলার চোখ যেন নিরুপায় লজ্জায় ম্লান হয়ে বলতে চায়, কী করব ননীদা, আমি যে পারছি না। ভেসে যাচ্ছি।
ননীর দপদপে চোখদুটো যেন নীরব তিরস্কারে ধিক্কার দেয়,ছি ছি, তুই এই!
মুখে কিন্তু আর তেমন সহজে তুই বলতে পারে না ননী। ঈর্ষার মত কেমন একটা সূক্ষ্ম জ্বালা-ধরা-মনে কেন কে জানে কেবলই ভাবতে থাকে ননী, কমলা তার থেকে অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে। ননীর থেকে, মাসির থেকে, তার সমস্ত পরিবেশের থেকে।
আর কমলা? সজ্ঞানে কিছুতেই যদি স্বীকার করতে না চায়, তবু অবচেতন মনে কমলাই কি ননীকে তার চাইতে অনেকটা নিচু স্তরের জীব বলে মনে করতে শুরু করেনি?
তাই ননী এসে ঘরে ঢুকে দূরে বসে।
কমলা অকারণে একখানা পড়া বইয়ের পাতা ওলটায়।
বই পড়া কমলার নতুন নয়, যা বিদ্যে অর্জন করবার সুযোগ পেয়েছিল ছেলেবেলায়, তাকেই চেষ্টা করে বাড়িয়ে বই সে পড়ে ফেলেছে বিস্তর। মাঝে একবার কিছুদিনের জন্য যখন ননীর কী যেন একটু ভাল চাকরি হয়েছিল, কমলাকে তো একটা লাইব্রেরিতেই ভরতি করে দিয়েছিল। তারপর অবিশ্যি সে চাকরিও ঘুচল, লাইব্রেরিও ঘুচল। কিন্তু যেমন করে তোক বই কমলা পড়েই। উঁচুদরের সাহিত্য না হলেও সিনেমা-পত্রিকা, বাজার-চলতি সাহিত্য।
ননী জানে। তবু আজ ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে, পড়ো পড়ো। পড়ে পড়ে বিদুষী হও। লেকচারবাবুর উপযুক্ত তো হতে হবে!
ছিঃ ননীদা! কমলা আরক্ত মুখে বলে, তুমি আজকাল যেন যা-তা হয়ে যাচ্ছ। কেবল এইসব বিচ্ছিরি কথা! শিখছি একটা কাজ ভালর জন্যেই তো? তা সেখানে তার সেক্রেটারি যাওয়া-আসা করবে না?
করবে বৈকি, একশোবার করবে আগে যেখানে মাসে তিনবার যেত, এখন সেখানে হপ্তায় তিনবার যাচ্ছে!
কমলার মুখটা লাল হয়ে ওঠে। কে জানে লজ্জায় না গর্বে?
তবে কথাতে কিছুই প্রকাশ পায় না। সহজভাবে বলে, আগে মাসে মাত্র তিনবার যেতেন, এ খবর কে দিয়েছে তোমায়?
খবর কাউকে কাছে এসে দিয়ে যেতে হয় না কমলা, খবর কানে হাঁটে। যাক ভালই তো, এ তো সুখবর! সুলক্ষণযুক্ত সময়ে দুজনের ফটো জুড়ে দিয়েছিলাম, এবার প্রজাপতি ঠাকুর সত্যি দুজনকে জুড়ে দেবেন!
আঃ ননীদা! ফের ওই পচা ঠাট্টা!
ঠাট্টা নয় সে তুমি নিজেই ভাল জানো কমলা। চারিদিকেই একথা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। শুনছি নাকি, ইন্দ্রবাবু এখন বাড়ি থেকে আউট হয়ে এসে কোন্ বন্ধুর ফ্ল্যাটে বাস করছে।
সে তো শুনি কাজের সুবিধের জন্যে।
তা তো শুনবেই। শোনা কথা শুনতে ভালই হয়।
কিন্তু মনের জ্বালায় ফের তুই সম্বোধনে ফিরে আসে ননী, বলিহারি যাই তোকে কমলি, জোচ্চুরি করে যা বলে এলি, শেষ অবধি তাই করলি? ওর গলায় পরাবার জন্যেই মালা গাঁথতে বসলি?
আচ্ছা ননীদা, তুমি কিগো? যা মুখে আসে তাই বলবে? তিনি কী, আর আমি কি, এ জ্ঞান কি তুমি হারিয়ে ফেলেছ?
জ্ঞান আমি হারিয়ে ফেলিনি কমলি, যে হারাবার সে হারিয়েছে। ওসব বড়লোকরা সুন্দরী মেয়ে দেখলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
কমলা গম্ভীরভাবে বলে, যা প্রাণ চায় বলো। আমি কিছু বলব না।
বলবার কিছু থাকলে তো বলবি? কিন্তু ভাবছি কমলি, তোরা মেয়েমানুষ–সব পারিস! অতবড় রুইটাকে কেমন গেঁথে তুললি!
আঃ ননীদা! দোহাই তোমার, ওঁর সম্বন্ধে এসব বিচ্ছিরি কথা বোলো না। উনি দয়ালু, সবাইকেই দয়া করেন। আমাকেও
দয়ালু!! দয়া করে সবাইকেই তাঁতঘর থেকে তাদের আপন আপন ঘরে সঙ্গে করে পৌঁছে দিয়ে যান, কেমন? সবাইয়ের জন্যেই তাঁতের মাকুর মতন সকল জায়গা থেকে ছুটে ছুটে তাঁতঘরে টানাপোড়েন করেন, কেমন? দয়া! আমাকে তুই আর হাইকোর্ট দেখাতে আসিসনি কমলি!
হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে ওঠে কমলা। জ্বলে উঠে জ্বলন্ত স্বরে বলে,–তুমিও আর আমাকে উত্ত্যক্ত করতে এসো না ননীদা। আমাকে নিজের মনে থাকতে দাও।
ওঃ! বুঝেছি! ননী তার সেই রাজাসন থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। মনে হল মুখখানায় তার কে যেন আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে। দুঃখে অপমানে ক্ষোভে বিকৃত সেই কালিপড়া মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে ননী বলে, বুঝেছি–তা এটুকু মুখ ফুটে বলতে বুঝি এতদিন চক্ষুলজ্জায় বাধছিল! বেশ চললাম।..নিষ্কণ্টক হও তুমি। তোমাদের ভগবান তোমায় সুখশান্তি দিন। কিন্তু মনে রেখো কমলা, যে পথে পা বাড়িয়েছ সে হচ্ছে চোরাবালি! হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে যায় ননী!
গরিব ননী, নিঃসহায় নিঃসঙ্গ ননী। জীবনযুদ্ধে পরাজিত বেচারা ননী।
.
ননী ছুটে বেরিয়ে গেল, কিন্তু কই, কমলা তো ছুটে বেরিয়ে আটকাতে গেল না তাকে?