মিসেস পাল মনে মনে জ্বলে যান। সুন্দর মুখ দেখে যেন একটু বেশি গলছেন সেক্রেটারি সাহেব। কিন্তু অনেক মেয়েকে ফেরাচ্ছেন মিসেস পাল, সে মনের জোর তার আছে। কাজেই দৃঢ়স্বরে বলেন, হতে পারে না ইন্দ্রনাথবাবু। আপনার এই তাঁতঘরখানার মত বড় ঘর যদি আমি পেতাম, অনায়াসে আরও দুগুণ মেয়ে নিতে পারতাম। এঁদের মধ্যেই কেউ কেউ প্রথম স্টেজদের শেখাতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু জায়গা কোথা? আপনাদের যে আবার কঠিন জেদ, গভর্নমেন্ট এড নেবেন না। যতটা কাজ হচ্ছে এখানে, সেটাই একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে দেখাতে পারলে সরকার থেকে মোটা টাকা সাহায্য পাওয়া যেত।
ইন্দ্রনাথ একটু হাসে, কাজের পরিমাণটা একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে দেখিয়ে সরকার থেকে মোটা টাকা আদায় তো চিরকালই আছে মিসেস পাল, হাজারো প্রতিষ্ঠান তা করছেও। একটা প্রতিষ্ঠান না হয় তা থেকে একটু পৃথক থাকল। সরকার তো নিজের ঘর থেকে দেন না, দেন জনসাধারণের কাছ থেকেই কুড়িয়ে। জনসাধারণ না হয় সরাসরিই দিল।
তা দিলে তো আর ভাবনা ছিল না। দেয় কই? মিসেস পাল আরও বেজার মুখে বলেন, মানুষ মানুষের মত আচরণ করলে তো আইন গড়বার দরকারই হত না। করে না বলেই আইনের প্যাঁচ কষে করিয়ে নেওয়া।
মেয়েটি চঞ্চলভাবে বারবার চোখ তুলে মিনতি জানাচ্ছে। ইন্দ্রনাথ শেষ চেষ্টা করে, তাহলে কিছুতেই সম্ভব নয়?
আপনি যখন বিশেষ করে বলছেন তখন সম্ভব করিয়ে নিতেই হবে।
মিসেস পালের বিশেষ শব্দটির উপর জোর দেওয়া কান এড়ায় না ইন্দ্রনাথের। একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। আগে হলে পড়ত না–এখন পড়ল। এখন বুঝছে সমাজের কাজ করে বেড়াতে হলে মিথ্যে দুর্নামকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা চলে না। তাই অগত্যাই বলে, তবে থাক। বুঝতে পারছি আপনি খুব অসুবিধেয় পড়েছেন। আচ্ছা, আমাদের উত্তর কলকাতার কেন্দ্রে যদি–ইয়ে শুনুন, কোথায় থাকেন আপনি? উত্তর কলকাতায় আমাদের একটা কেন্দ্র আছে, সেখানে চেষ্টা করলে হয়তো
আমি এখানেই থাকি। ওই নতুন ইস্কুলটার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা সাঁকোর দিকে গেছে, সেই রাস্তায়।
তাই তো, তাহলে তো খুব সুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না! যাতায়াতের খরচাতেই তো
তবে–মেয়েটি ব্যগ্রভাবে বলে, যেখানে থোক, যে করে তোক আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন। সেলাই হোক যা হোক।নইলে আমার যে কী হবে!
তাঁত চালাতে শিখবেন? একটু হাসে ইন্দ্রনাথ।
আপনি যা বলবেন তাই করব। একটা কিছু করে নিজে দাঁড়াতে চাই আমি।
আমরাও তো তাই চাই, হাসে ইন্দ্র, কী বলেন মিসেস পাল?
মিসেস পাল আর কিছু বলেন না।
ইন্দ্রনাথই ফের বলে, ঠিক আছে, তাহলে আমাদের একটি কর্মী ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনাকে তাঁতঘরে নিয়ে গিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়ে ভর্তি করে নেবে, কেমন?
নীরবে ঘাড় কাৎ করে মেয়েটি।
আচ্ছা, কিন্তু এদিকে তো সন্ধ্যে হয়ে আসছে–দেরি করলে তাঁতঘর বন্ধ হয়ে যাবে। এক কাজ করুন, আমার সঙ্গেই চলুন। আমি ওখানে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে বলে-কয়ে চলে যাব। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস। খুব ইন্টারেস্টিং, একটু মন দিয়ে শিখতে চেষ্টা করলে দেখবেন খুব ভাল লাগবে। চলুন তবে চটপট।
ইন্দ্রনাথ এগোতে থাকে। পিছন পিছন মেয়েটি।
মিসেস পাল অস্ফুট মন্তব্য করেন, আমি বুঝেই ছিলাম!
.
তাঁতঘর সেই সাঁকোর ওপারে। যেদিকে সূর্য ঢলছে।
চারিদিক সোনায় সোনা। গাছের মাথায় মাথায় সোনা রোদ, মাটির বুকে বুকে সোনালি আলো, পশ্চিমমুখী পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া মানুষ দুটোর মুখে সোনারঙা আবীর।
আগে পিছের বাধা দূর হয়ে ক্রমশ কখন পাশাপাশি হয়ে পড়েছে দুজনে।
নীরবতা অস্বস্তিকর। ইন্দ্রনাথ কথা বলছে।
বাড়িতে আপনার কে কে আছেন?
মাসিমা।
মাত্র? আর কেউ না?
আর কেউ না।
এদিকে কতদূর এগিয়েছিলেন? মানে আর কি, স্কুলে!
সামান্যই। মাসিমার অবস্থা ভাল নয়।
আমাদের দেশে কজনেরই বা অবস্থা ভাল মিসেস মিস
আমার নাম কমলা।
ওঃ আচ্ছা! এখানকার ছাত্রীদের অনেককেই আমি নাম ধরে বলি।
আমাকেও বলবেন। চোখ তুলে কথাটা বলে বুঝি চোখ নামাতে ভুলে যায় কমলা।…এই সেই মুখ। যে মুখ প্রতিনিয়ত কী এক দুর্বার আকর্ষণে কমলাকে কেন্দ্রচ্যুত করতে চাইছে! দিনে দিনে ভেঙেচুরে গড়ছে কমলাকে–পুরনো কমলা ক্রমশই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
কী সুন্দর! কী অপূর্ব!
ইন্দ্রনাথও একটু অবাক হয়েছে বৈকি। এতক্ষণ মেয়েটার মুখ এত নিচু ছিল যে ভাল করে দেখতেই পাওয়া যাচ্ছিল না, এখন দেখে অবাক হল।
দুপাশে দুটি ঝোলানো বেণী, কপালের উপর চুলের থাক, দীর্ঘ পল্লবে ঘেরা চোখ দুটি কী বড় বড় আর কোমল কালো! আর সেই চুলের পটভূমির উপর ওই চোখের ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যান্বিত সমস্ত মুখটা একেবারে নিখুঁত সুন্দর!
অবশ্য এই রূপ দেখেই যে অবাক হল ইন্দ্রনাথ তা নয়, অবাক হল এই ভেবে যে, এমন মেয়ের বিয়ে হয়ে ওঠেনি কেন? নিজের পায়ের দাঁড়াবার জন্যে এর এত আকুলতা কেন? তবে কি বিধবা?
এমন সুকুমারমুখী কিশোরী কি বিধবা হওয়া সম্ভব? হা, কিশোরীই মনে হয় কমলাকে!
ওর মুখশ্রীর জন্যেই মনে হয়, মনে হয় ওর সুগঠিত দেহের জন্যে। অমন সুকুমার মুখ, আর অমন বিশাল ঢলঢল চোখ বলেই না অমন করে লোকের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে কমলা! ওই চোখের আয়ত বিষণ্ণ দৃষ্টি, আর মুক্তাবিন্দুর মত অশ্রু!