আর ওই ছিটের ব্লাউজটা! ওটা ফুটপাতের ধারে পার্কের রেলিঙের গায়ে নিজের সৌন্দর্য বিস্তার করে ঝুলছিল, সে সৌন্দর্যে ননীর প্রাণ মোহিত হয়ে উঠল, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কিনে ফেলল জামাটা নগদ দুটাকা বারো আনা দিয়ে।
এই খরচার জন্যে ননীকে অবশ্যই নিজের অবশ্য প্রয়োজনীয় থেকেও কিছুটা বঞ্চিত হতে হবে, তা হোক, তবু আজ ননী যেন হাওয়ায় ভাসছে।
.
কেনার পর বাড়ি এসে কাগজের প্যাকেটটা খুলে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিল, আন্দাজ করতে চেষ্টা করল গায়ে ঠিক হবে কিনা কমলির, তারপর নিশ্চিত হল নিশ্চয়ই হবে। কমলির সম্পর্কে ননীর আন্দাজ কি ভুল হতে পারে?
হাতের জিনিসটা খপ করে পিছনে চালান করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেও কেষ্টমোহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না ননী। কেষ্টমোহিনী হাঁক দিয়ে উঠল, হাতে কী রে ননী?
কিছু না তো মাসি! ননী দরাজ গলায় বলে।
অমন ডাহা মিথ্যে কথা বলিসনে ননী, মুখে পোকা পড়বে। কমলির জন্যে কিছু এনেছিস বুঝি? খাবারদাবার?
না না, খাবার-দাবার আবার কি! ইয়ে–একটা চুলে মাখবার তেল। দুঃখু করছিল সেদিন, চুলগুলো সব শেষ হয়ে গেল ননীদা।
হু, দুঃখু জানাবার জন্যে যখন এমন সোহাগের ননীদা রয়েছে, আর জানালেই তার প্রতিকারের আশা রয়েছে তখন জানাবে বৈকি! কিন্তু তোর মতন এমন নেমকহারাম দেখলাম না রে ননী। বলি আমার এই মুখখানা যে মেচেতা পড়ে পড়ে একেবারে কালো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, তা তো কোনদিন তাকিয়ে দেখিস না! বলিস না তো যে মাসি এই ওষুধটা মেখে দেখ! হুঁ, মেচেতা…বলে বাতের ব্যথায় উঠতে নড়তে বাপকে ডাকি, তাই একটু ওষুধ জোটে না…
ননী এবার ব্যাজার মুখে বলে, তা তুমি যদি সব পয়সা জমাও! নইলে–।
খবরদার ননী। জমানোর খোঁটা দিসনে। পয়সা আমি জমাই? জমাতে পাই? দুদুটো মানুষের খরচ নেই?
ননী প্রমাদ গুনে বলে, আহা তা কি আর আমার জানা নেই মাসি! বিশেষ এই বাজারে। ও তোমায় ঠাট্টা করলাম একটু।
ঠাট্টা! পোড়াকপাল আমার! ঠাট্টা করবার আর সুবাদ পেলে না তুমি! কিন্তু ও বস্তু নিয়ে এগোচ্ছ কোথায়? কমলি ঘরে নেই
ঘরে নেই? কোথায় গেছে? টিউবওয়েলে?
তুই আর বকিসনে ননী! রাজনন্দিনী আবার কবে টিপকলে যান? সব জল বইবার ভার তো এই বুড়ির।–তিনি গিয়েছেন বেড়াতে।
বেড়াতে! একলা!
হ্যাঁ। ক্রমশ ডানা গজাবে তো! তোকে এই বলে দিলাম ননী, এরপর দেখে নিস, ও তোরও থাকবে না, আমারও থাকবে না! পাখা মেলে উড়বে! বলে কিনা কে কোথায় বিনি মাইনেয় সেলাই-ইস্কুল খুলেছে, তাইতে ভর্তি হবে!
সেলাইয়ের ইস্কুল?
হ্যাঁ রে হ্যাঁ। সেলাই শিখে দর্জি হবে। দর্জিগিরি করে পেট চালাবে। সেই সেদিনের সেখেনে আর একবার নিয়ে যাবার জন্য ঝুলোঝুলি করছি–পিসি মাগী তো বলেছিল, আপাতত মাসে মাসে কিছু কিছু করে দেবে–তা রাজনন্দিনী কিছুতে রাজী হলেন না। এখন নতুন করে ওঁর নাকি লজ্জা করে, ভয় করে! কাল করেছিস ননী ওই ছবি তুলে! চব্বিশ ঘণ্টা ঘরের কোণে বসে ওই ছবি নিয়ে দেখছে নাড়ছে তুলছে রাখছে। যেন সত্যি-বিয়ের বরের মুখ…মুখ কালি করে আর কী হবে বাছা! শান্তরেই আছে কাগের বাসায় কোকিল থাকে যতদিন না উড়তে শেখে, উড়তে শিখে ধর্ম রেখে চলে যায় সে অন্যবন!..তোর আর কী! আমারই সর্বনাশ। তিন তিনশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম, এতদিন খাওয়ালাম পরালাম, সব জলে যেতে বসেছে গা। সৎপথে থেকে উনি দুদুটো মানুষের পেট চালাবেন! হুঁ, পিরথিবীটা তেমনি সৎ যে!
ননীর আর উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। ননীর বুকে শক্তিশেল পড়েছে। বিনি মাইনের সেলাই-স্কুল কে খুলেছে, সে কথা কেষ্টমোহিনী না জানলেও ননী তো ভালই জানে।
.
মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েছিল কমলা। চোখ তুলে তাকাবার সাধ্য নেই। পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে, কঁপছে বুক।
শিক্ষয়িত্ৰী অনিমা পাল জনান্তিকে বলেন, এই আর একটি নতুন মেয়ে ভর্তি হতে এসেছে ইন্দ্রবাবু। এখন কী করি বলুন? সীট তো আর নেই!
ইন্দ্রনাথ নতুন মেয়ের প্রতি একবার তাকিয়ে বিব্রত ভাবে বলে, একেবারে নেই?
কোথা থেকে থাকবে বলুন? একেই তো এমন যুগ পড়েছে, মেয়েপুরুষ ইতরভদ্র সবাই কোন একটা কিছু শেখবার জন্যে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, মাইনে নেওয়া স্কুলেরাই দেশের চাহিদা মেটাতে পারছে না, তার ওপর আবার আপনার এই উইদাউট ফী–! দলে দলে মেয়ে আসছে, ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু এ মেয়েটি একেবারে নাছোড়!
ইন্দ্রনাথ একবার অদূরবর্তিণীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে মিনতির সুরে বলে, এত যখন ইচ্ছে, কোনমতে নিয়ে নিতে পারবেন না মিসেস পাল?
মিসেস পাল নিতান্ত বেজার হন। মেয়েটি সম্বন্ধে তিনি কিঞ্চিৎ সন্দেহযুক্ত। ঠিক ভদ্রঘরের মেয়ে কি? থাকে তো কলোনিতে। সে কলোনিরও সুনাম নেই। তাছাড়া জায়গা তো সত্যিই নেই, প্রায় প্রতিদিনই দুপাঁচজনকে নিরাশ করতে হচ্ছে। আর এ যেন ছিনেজোঁক! কেবল একঘেয়ে কথা, দয়া করে যদি–! আরে বাবা, দয়া যদি করতেই হয়, তুই ছাড়া কি আর উপযুক্ত পাত্র নেই?
কিন্তু মনের কথা মনে থাক। অনিমা পাল বেজার মুখে বলেন, কী করে নিই বলুন? একে তো ঘর ছোট, তাছাড়া মেশিন কই? তিনটে শিফটে কুলিয়ে উঠতে পারছি না!
আচ্ছা আর একটা মেশিনের ব্যবস্থা আমরা করব মিসেস পাল, শীগগিরই করব, কিন্তু ঘরের ব্যবস্থা তো চট করে করা সম্ভব নয়। এখন ওর মধ্যেই যা হয় করে যদি এই আর একটা সীট