জানা তো নেই। ইন্দ্র হেসে ওঠে, এযাবৎ তো নিজেকে অজাতশত্রু ভেবে বেশ একটা আত্মগৌরবই ছিল।
ভুল, খুব ভুল। জগতে ভাল লোকদেরই শত্ৰু বেশি থাকে। কে জানে আমাদের এই সঙ্গের অনিষ্টসাধক কেউ আছে কিনা, তোমার একটা দুর্নাম রটিয়ে যার ইষ্টসিদ্ধি হবে?
ত্রিজগতে এমন কোন নাম মনে আসছে না বাদল, আমার অনিষ্টে যার ইষ্টসিদ্ধি! এ স্রেফ টাকা আদায়ের কল! যত রাজ্যের রদ্দি ডিটেকটিভ গল্প পড়ে পড়ে দেশে এসব বিজাতীয় দুর্বুদ্ধির চাষ হচ্ছে!
মেনে নেওয়া শক্ত হচ্ছে। কাউকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মানে বুঝি, কিন্তু এ কী?
এ আর একটা নতুন ফ্যাশান। হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ।
হেসো না তুমি ইন্দ্রদা।
তাছাড়া আর কী করবার আছে?
কিছু করবার নেই?…আশ্চর্য!…বদমাইশদের খুঁজে বার করতে হবে না?
খুঁজতে যাওয়া মানেই কতকগুলো কুশ্রী কথা আর কুশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হওয়া!
তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে?
থেকেই দেখা যাক না। হেসে ওঠে ইন্দ্র, সত্য যদি সত্যিই সূর্যের মত হয় তাহলে একদিন না একদিন মেঘমুক্ত হবেই।
আর তুমি সেই দিনের প্রত্যাশায় এই ভবঘুরে ভিখিরীর মতন হাটেবাজারে পড়ে থাকবে?
ক্ষতি কী? এও তো মন্দ লাগছে না। দেশে এমন অনেক ভদ্রলোক আছে বাদল, যারা এভাবে থাকতে পেলেও ধন্য হয়ে যায়।
বাদল রেগে উঠে বলে, তুলনা করার কোনও মানে হয় না ইন্দ্রদা। দেশে এমন অনেক লোকও আছে যারা ফুটপাথের কোণে একটু জায়গা পেলেও ধন্য হয়ে যায়!–ওসব দার্শনিক কথা ছাড়ো। কথা হচ্ছে, অপরাধীর সন্ধান নিতে হবে।
হয়তো সন্ধান পাওয়া খুব একটা শক্ত নয়! হয়তো আরও আসতে পারে–গাছ নাড়া দিয়ে ফের ফুল কুড়োতে! এরকম অপরাধীরা যদি না ধমক খায় তো বারে বারে আসে ভয় দেখাতে। পিসিমা কি আর তাদের মুখ বন্ধ করতে কিছু-না-কিছু না দেবেন?
যা-ই বল ইন্দ্রদা, পিসিমার বিশ্বাস করাকে বলিহারী দিচ্ছি আমি!
মানুষ তো প্রতারিত হয়ই বাদল।
হোক–তবু তার একটা মাত্রা থাকে। কিন্তু ইদা, ওই ফটো না কী বললে, ওটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না!
বুঝতে আমিও খুব পারিনি বাদল, যা শুনেছি তাই বললাম তোকে।
আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ইন্দ্রজাল।
ইন্দ্রজাল!
হ্যাঁ তাই! আসলে কিছুই নয়, সাদা কাগজ। পিসিমাকে মেসমেরাইজ করেছে তারা।
পাঁচদিন পরে আজ নিজস্ব স্বভাবে দরাজ গলায় হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ। হেসে বলে, এই আর একবার শ্রীমান বাদলচন্দ্রের বুদ্ধির কাছে হার হলো আমার! বাস্তবিক এত সহজ কথাটা বুঝতে পারছিলাম না এতদিন!
কিন্তু বাদল উপহাসে হার মানবার ছেলে নয়, ও সংকল্প করে, যে করেই হোক এ রহস্যের সূত্র আবিষ্কার করবেই, ইন্দ্রদা, আমি যাচ্ছি পিসিমার কাছে।
এই বাদল, ওইটি করতে যেও না।
কেন বলো? আমি কি কখনো পিসিমার কাছে যাই না?
সে তুমি পিসিমার হাতের চন্দরপুলি, গোকুল পিঠে খেতে যেতে পার, কিন্তু এখন যাওয়া চলবে না। পিসিমা যে ভেবে বসবেন সন্ধির দূত হিসেবে তোমায় পাঠিয়েছি আমি, সে হতে দেব না।
আমি পুত্থানুপুঙ্খ জানতে চাই।
লাভ কী? কোন এক পক্ষ প্রতারণা করেছে আর অপর এক পক্ষ প্রতারিত হয়েছে, মূল ঘটনা তো এই! এর থেকে কারো বা কিছু ধনহানি হয়েছে, কারো বা কিছুটা মানহানি হয়েছে
কারো বা কোথাও প্রাণহানি হবে, দেখতে পাচ্ছি দিব্যচক্ষে। বলে ওঠে বাদল।
বাদল! রীতিমত বিরক্ত স্বরে বলে ইন্দ্রনাথ–আমি আরও একটা জিনিস দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
কী? কী দেখছ?
এই তোমার সঙ্গেও সম্পর্ক রহিত! এভাবে আমাকে বিরক্ত করলে সব ছেড়েছুঁড়ে পালাব?
বেশ ঠিক আছে, পিসিমার কাছে আমি যাব না, কিন্তু এ চক্রান্তের সূত্র অন্বেষণ করতে পাব না, তুমি এমন হুকুম যদি দাও, তাহলে জেনো আমার হাতেও শাস্তির অস্ত্র আছে!
উঃ, বড্ড যে ভীতিপ্রদর্শন! তবে যা, জগতের যত গোয়েন্দাকুল আছে–মনে মনে সকলেব পদবন্দনা করে অভিযানে বেরিয়ে পড়! আসামীর আঙুলের ছাপ যদি নাও পাস, নিদেন দুএকগাছা ছেঁড়া চুল, অথবা
আচ্ছা এখন ঠাট্টা করছ, পরে—
পূজো করব, কী বলিস!
আঃ, ধ্যেৎ!
দ্যাখ বাদল, বাজে চিন্তা ছাড়। সঙ্রে আগামী অধিবেশনে
রাখো ইন্দ্রদা তোমার আগামী অধিবেশন! আমার মাথায় এখন,না থাক, এখুনি ফাস করব না।
.
বাদল চলে যায়।
ইন্দ্র ভাবে ওকে না বললেই বোধহয় ভাল হত! কী না কী একটা ফ্যাচাং বাধাবে!
অপরাধীকে উচিত শাস্তি দেবার উপযুক্ত প্রতিশোধ-স্পৃহা আপাতত নেই, কেমন একটা নির্বেদ ভাব এসে গেছে।
মাইনের মত মাইনে নয়। বলতে লজ্জা ভাবতে লজ্জা। তবু মাইনেটা পেলেই কমলির জন্যে কিছু-না-কিছু কেনে ননী। হয় সাবান নয় পাউডার, নয়তো বা দুগজ ফিতে, কি চারটি মাথার কাটা। নেহাতই তুচ্ছ বস্তু, তবু সেই তুচ্ছটুকুই দাতার হৃদয়-ঐশ্বর্যে পরম মূল্যবান হয়ে ওঠে।
আজ ননীর সেই মাইনের দিন। পরম লজ্জা আর পরম সুখের দিন।
সকাল থেকে কল্পনার পটে এঁকে চলেছে এক টুকরো সুখের ছবি। এবার একটা বড় রকমের খরচা করে ফেলেছে ননী, কিনেছে একটা ছিটের ব্লাউজ আর এক শিশি জবাকুসুম।
কথায় কথায় কমলা একদিন বলেছিল, বেজায় চুল উঠে যাচ্ছে কেন বল তো ননীদা? কী করা যায়?
তখন ননী ঠাট্টা করে বলেছিল, ভাবনাচিন্তাগুলো একটু কমা কমলি, অষ্টপ্রহর আকাশপাতাল ভেবে ভেবেই তোর মাথার চুল সব ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু মনে মনে সংকল্প করেছিল, একটা সত্যিকার ভাল গন্ধতেল নিয়ে আসবে কমলার জন্যে!