কমলারা অবশ্য বিয়ে শব্দটা ব্যবহার করে। কিন্তু সমাজকে লুকিয়ে যে বিয়ে, তাকে কি আর লোকে সত্যি বিয়ে বলে সম্মান দেয়?
.
হঠাৎ ছবিখানা বিছানার তলায় খুঁজে রেখে দিল কমলা। ক্রমশ যত দেখছে তত যেন গা ছমছম করছে।
আস্ত লোকটাকে আর একবার পাওয়া যায় না? দূর থেকে…অনেক দূর থেকে!
.
খোঁজ পেলি না চন্দর? ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নীহারকণা। সেরাত্রে নয়, তার পরদিন দুপুরে।
চন্দ্রনাথ বিছানায় বসে পড়ে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, পেয়েছি।
পেয়েছিস?..আঁ, পেয়েছিস? তবে একলা এলি যে? ও চন্দর, অমন গুম হয়ে রয়েছিস কেন? কোথায় রেখে এলি তাকে? হাসপাতালে না–
শেষ পরিণামের শব্দটা আর উচ্চারণ করেন না নীহারকণা। হাঁপাতে থাকেন।
চন্দ্রনাথ হাত তুলে শান্ত হবার ইশারা করে বলেন, রেখে কোথাও আসিনি, দেখে এলাম তার অফিসে। কাজ করছে।
অফিসে কাজ করছে। আঃ নারায়ণ! বাবা বিশ্বনাথ! মা মঙ্গলচণ্ডী!…আসবে তো সন্ধ্যেবেলা? আসবে না তো আর যাবে কোথায়? রাগ আর কতকাল থাকে মানুষের?–তা কাল রাত্তিরে ছিল কোথায় হতভাগা? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিল বোধহয়। হাসি আর কান্নার এক অপূর্ব রামধনু রঙে উথলে ওঠে নীহারকণার মুখ।
রোস রোস, একে একে তোমার কথার উত্তর দিই।
কী বললে? কাল রাত্তিরে ছিল কোথায়? ছিল ওদের সেই সঙ্ঘের অফিসঘরে। তারপর কী বললে? কতক্ষণ রাগ থাকে মানুষের? বলা যায় না, হয়তো চিরকাল। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরবে কিনা?…না, ফিরবে না।
ফিরবে না?
না।
ভুলের মাপ নেই?
মাপ চাইনি।
খানিকক্ষণ নিঃসীম স্তব্ধতা। তারপর নীহারকণা বলে ওঠেন, তুমি সেসব কথার কিছু জিজ্ঞেস করনি? সত্যি কি মিথ্যে, কে এমন শত্রু আছে তার যে এতবড় ষড়যন্ত্র করেছে?
অফিসের মাঝখানে ওসব কথা! তাছাড়া কোনখানেই কি জিজ্ঞেস করতে পারতাম? না দিদি, সে সাধ্য আমার নেই। শুধু সহজভাবে বললাম, তোমার পিসিমা বড় ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন, অফিস মিটলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি আমাদের সঙ্ঘের ওখানেই এখন কদিন থাকব বাবা। তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করে নেব। বললাম, তোমার পিসিমা বড্ড বেশি কাতর হবেন– একটু হেসে বলল, আপনি তো আর হবেন না। শুধু পিসিমা। তাকে বলবেন আমি ভালই আছি।
চন্দ্রনাথের গতকাল থেকে ভিজে হয়ে থাকা দুটি চোখের কোণ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। গোপন করবার আর চেষ্টা করেন না।
নীহারকণা হঠাৎ ধিক্কার দিয়ে ওঠেন, ছি ছি! এত নিষ্ঠুর! এতটুকু মমতা নেই!
আমরাও তো কম নিষ্ঠুর নই দিদি, আমরাও তো তাকে মমতা করিনি।
৩. কী ব্যাপার ইন্দ্রদা
কী ব্যাপার ইন্দ্রদা? তুমি যে এখানেই আড্ডা গাড়লে? নতুন সুটকেস, নতুন জামাকাপড়!… কী হল বল তো? বাড়ি থেকে পালিয়ে নয় তো? বাদল নামক ইন্দ্রের পরম অনুরক্ত কর্মী ছেলেটি প্রশ্ন করে ইন্দ্রকে হাসতে হাসতে।
ইন্দ্রও হেসে ওঠে, বৃথাই তোকে দোষ দিই বাদল বুদ্ধিহীন বলে, বেশ সহজেই ধরে ফেলেছিস তো!
ঠাট্টা রাখ ইন্দ্রদা, সত্যি বল ব্যাপারটা কী? কাল-পরশু কিছু ভাবিনি, মনে করেছিলাম খুব বড়গোছের কিছু একটা প্ল্যান করছ বোধহয়, নাওয়া-খাওয়া ভুলতে হবে! তাই বাড়িতে মার খাবার ভয়ে দুদিন এখানে এসে আড্ডা গেড়েছ!..কিন্তু তোমার এই নতুন সুটকেস আর নতুন জামাকাপড় যে একটু ভাবনা ধরাচ্ছে!
ভাবনার কী আছে রে বাদল? চিরদিনই কি বাপের হোটেলে থাকব? বড় হয়েছি, চাকরি বাকরি করছি
ছেঁদো কথা রাখো ইন্দ্রদা, নির্ঘাৎ একটা কিছু ঘটেছে। কিন্তু বাড়িতে মনোমালিন্য করে বাড়ি থেকে পালিয়ে?–তুমি! উঁহু, হিসেব মিলছে না তো!
জগতের সব হিসেবই কি আর মেলে বাদল! ভেবেছিলাম মরুকগে যে যার খাতায় যে যার। অঙ্ক নিয়ে থাকুক! চলে যাবেই যা হোক করে! কিন্তু তোকে নিয়েই মুশকিল। তুই আমার বারণ শুনবি, এ ভরসা নেই। নিশ্চয় ছুটে যাবি মিটমাট করাতে।…কেমন তাই তো?
নিশ্চয় তো! এই এখুনি চললাম।
যাবে বৈকি! আমার গার্জেন যে তুমি!
গার্জেন-টার্জেন বুঝি না ইন্দ্রদা। এসব উল্টোপাল্টা ব্যাপার আমার ভাল লাগছে না।
তা জগৎসংসারে সবই কি আর সোজা হবে? কিছু তো উল্টোপাল্টা হবেই রে!
তাই বলে তো আর নিশ্চিন্ত হয়ে ছেড়ে দেওয়া চলে না! সোজা করে নেবার চেষ্টা করতে হবে। আমি তো ভেবে পাচ্ছিনে তুমি হেন লোক বাড়ি থেকে ঝগড়া করে
ঝগড়া করে!
হো হো করে হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ,-ঝগড়া কি বল?
আচ্ছা না হয় মনোমালিন্যই
দূর পাগলা!
তা কী তাই বলো?
কী তাই বলব? বলতে তোকে পারি তবে বিশ্বাস-অবিশ্বাস তোর হাতে!
.
নিতান্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে সেদিনের ইতিহাসটুকু বিবৃত করল ইন্দ্রনাথ বাদলের কাছে।
স্তম্ভিত বাদল সব শুনে প্রায় ধিক্কারের সুরে বলে–বাঃ বাঃ চমৎকার! এই হল আর অমনি তুমি সর্বত্যাগী হয়ে চলে এলে? প্রতিবাদ করলে না?
খুব বেশি না।
কেন খুব বেশি না? ধিক্কারে একেবারে ইয়ে করে দিতে পারলে না? বলতে পারলে না একটা রাস্তার লোকের কথা এত বিশ্বাস হল তোমাদের যে–
মুখে বলে লাভ কী?
ও, প্রতিবাদটা কাজে করেছ? এটা আবার বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাবছি
তা তোরই বা আমার সব কথা বিশ্বাস হচ্ছে কেন? কেন ভাবছিস না আমি বানিয়ে বানিয়ে নিরপরাধ সাজছি!
থামো ইন্দ্রদা! ইন্দ্রকে প্রায় ধমকে ওঠে বাদল,–আমি ভাবছি কে তোমার এমন শত্রু আছে যে এই চক্রান্তটি করছে!