তারপর সসঙ্কোচে ব্যক্ত করেছিল কমলা হৃদয়ের মৃদু প্রতিবাদ-এত ভাল ভদ্রলোক, সকলের কত উপকার করছেন দেখতে পাই, ওঁকে কেন বাপু
কথা শেষ করতে দেয়নি ননী, খিঁচিয়ে উঠেছিল, থাম কমলি, মেজাজ খারাপ করে দিসনি। ভদ্রলোক! ভাল লোক! বস্তিতে কলোনিতে লেকচার দিয়ে বেড়ানো লোক আমি নতুন দেখছিনে। যত সব মতলববাজের দল। নিশ্চয় সামনের বছর ইলেকশানে নামবে। এখন তাই দেশের গরিবদুঃখীদের জন্যে কুমীরকান্না কেঁদে বেড়াচ্ছে। এইসব লোককেই পাঁকে পুঁতে দিতে হয়, বুঝলি ঘলি!
বলতে বলতে রাগে ফুলে উঠেছিল ননী, এরা আমাদের মতন গরিবদের হ্যাঁন করব, ত্যান করব বলে দুটো মিষ্টি কথা আর একটু মুষ্টিভিক্ষেয় ভুলিয়ে ভোটের ব্যবস্থাটি করে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নেয়, আমাদের মই বানিয়ে উঁচু গাছের মগডালে চড়ে বসে, তারপর আর আমাদের চিনতে পারে না! এই পাঞ্জাবি উড়িয়ে বেড়ানো উপকার করা বাবুগুলোকে দেখলেই তাই গা-জ্বালা করে আমার! ওর মুখে চুনকালি পড়ক তাই চাই আমি। আর তাতে পাপও নেই। এসব লোকের চরিত্রই কি ভীষ্মদেব হয় নাকি? হয়তো খবর নিলে জানবি আরও কত কেষ্ট ঠাকুরালি করে বেড়িয়েছে।
তবু কমলা সসঙ্কোচে বলেছিল, এঁকে কিন্তু তেমন মনে হয় না ননীদা।
নাঃ, মনে হয় না! ওর কার্তিকের মতন চেহারা দেখে বুঝি মন গলে গেছে? এই তোকে বলে রাখছি কমলি, এ জগতে দেখতে পাবি যে যত দেবদূতের মতন দেখতে, সে তত ফেরেববাজ! তুই যদি ওর চেহারা দেখে
আমি ওকে দেখিইনি ভাল করে। কমলা বলেছিল তাড়াতাড়ি ভয়ে ভয়ে।
আর দেখতে হবেও না। ওকেই দেখিয়ে দিবি। খুব শাঁসালো ঘরের ছেলে, বেশ কিছু আদায় করা যাবে।
কমলা ম্লানমুখে বলেছিল, আমার কিন্তু বড় ভয় করে ননীদা। প্রত্যেকবারই ভয় করে। ..সত্যি সত্যি যদি কেউ পুলিসে ধরিয়ে দেয়? তখন তো সব জোচ্চুরি ধরা পড়ে যাবে? জেলে যেতে হবে আমাদের।
পুলিসে দেবে না। ননী একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে। জানি আমি বড়লোকদের বদনামের ভয়টা বড্ড বেশি। মহা মিথ্যে বলে বুঝলেও পুলিস-জানাজানি করে সমাজে মাথা হেট হতে চায় না। তাই চারটি টাকা দিলে যদি মেটে তো মিটুক বলে ঘুষ দেয়।
সত্যি কথা প্রকাশ হলে সমাজে মাথা হেঁট হবে কেন ননীদা?
কেন? হো হো করে হেসে উঠেছিল ননী, তুই এখনো নেহাৎ ছেলেমানুষ আছিস কমলি। সমাজ কি সত্যি কথাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করবে? কেউ করবে না। বাপ ছেলেকে বিশ্বাস করবে না, ছেলে বাপকে বিশ্বাস করবে না। তা ভাই বন্ধু আত্মপর তো দূরের কথা! যতই ধর্মের জয়–অধর্মের পরাজয় হোক, লোকে ভাববে পুলিসকে হাত করে ডঙ্কা বাজিয়ে জিতে গেল। অথচ কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হবে, ঢাকে ঢোলে কাঠি পড়বে, খবরের কাগজওলাগুলো জেনে বুঝেও কায়দা করে রংচং চড়িয়ে খবর ছাপবে। জানে তো সবই। সবাই জানে। তাতেই তো মাসিকে আর তোকে এই পথ ধরিয়েছি। তবে সাবধান, মাসিকে সঙ্গে করে ভিন্ন এক পা নড়বি না। একলা পেলেই মেরে গুমখুন করে ফেলবে।
নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করেছিল কমলা।
.
তারপর ননী এক অদ্ভুত কাজ করল। কোথা থেকে কিনে নিয়ে এল একসেট ফুলের গহনা। বলল, তোর সব থেকে ভাল শাড়িটা আর এইগুলো পরে নে কমলি।
সে কি গো ননীদা! না না, এমন সং সাজতে পারব না আমি!
সং কী রে? রানী, রানী! কেমন একটা হতাশ হতাশ মুখে বলেছিল ননী, রটাতে হবে রাজপুত্তুর তোর গলায় মালা দিয়েছে, তা একটু রানী-রানী না দেখালে মানাবে কেন? এ ছবি বাছাধনের মাকে দেখালেই তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। একেবারে বিয়ের বরকনের যুগল ছবি!
যুগল ছবি কথাটা ননীর কাছেই শোনা কমলার।
সত্যিই কনে সেজেছিল সেদিন কমলা।
ফটো তোলার পর ননী আবেগ-আবেগ গলায় বলেছিল, এ ছবি আমার কাছে রেখে দেব একখানা। কী করব রে কমলি অনেক যে খরচা, নইলে কত ছবি তুলতাম তোর!
.
ছবিখানা তুলে রাখতে গিয়ে আবার একবার চোখের সামনে ধরে বসে রইল কমলা।
ওই চোখ দুটো কি তাকে ভর্ৎসনা করছে? বলছে, ছি ছি, তুমি এমন নীচ? এত ইতর?
সেদিন ওদের বাড়িতে গিয়েও যেন এমনি হয়েছিল কমলার। মনে হচ্ছিল সমস্ত বাড়িখানা তার আসবাবপত্র শোভা-সৌন্দর্য সমেত যেন অনবরত ভর্ৎসনা করছে ছি ছি, তুমি এমন নীচ!
তিনতলায় উঠে তো ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল কমলার। এ কী! মাসি আর ননীদা কি পাগল?
ওইখানে, ওই ঘরে ঢুকে বলতে হবে, তোমাদের ছেলে এই কমলাকে বিয়ে করেছে! যে কমলা দুখানার বেশি চারখানা শাড়ি কোনদিন পরেনি, দুবেলার বেশি চারবেলা কখনো খেতে পায়নি! আর যার পিঠের জামা খুললে এখনো কেষ্টমোহিনীর হাতের মারের দাগ খুঁজে পাওয়া যায়! এর আগে এত বড় জায়গায় কখনো আসেনি কমলা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভয়ঙ্কর অসম্ভব কথাটা বলা হয়েছিল। আর মিলে গিয়েছিল ননীদাদের হিসেবটাই। ওই ইন্দ্রবাবুর পিসিমা এই মারি এই মারি করেও শেষ অবধি বিশ্বাস করেছিলেন। কেষ্টমোহিনীর হাত ধরে বলেছিলেন, দেখ ভাই, একথা যেন সাত-কান না হয়। তোমার মেয়ে আর নাতির কষ্ট যাতে না হয় সে ব্যবস্থা আমি করব। আর এই একটু মিষ্টি খেও বলে সেই হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন একশখানি টাকা।
ননীদাদের হিসেবটাই ঠিক। স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কিত ব্যাপারে জগতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না!
কিংবা কিংবা ননীদার সে কথাটাও হয়তো সত্যি। হয়তো স্বভাব-চরিত্র ভালই নয় ওর, তাই ওর পিসি এত সহজেই..