রাগ নয়রে কমলি, ধিক্কার। মাসি তো আজ আমাকে জুতো মারতেই বাকী রেখেছে শুধু। বলেছে, ফের এ বাড়িতে এলে সত্যি জুতো মারবে।
বলেছে এই কথা? ঠিকরে দাঁড়িয়ে ওঠে কমলা।
প্রায় ওই কথাই।
তবু তুমি এলে?
এলাম তো!
সত্যিই গলায় দড়ি দেওয়া উচিত তোমার ননীদা। যাও বলছি এখুনি।
তুইও তাড়াচ্ছিস?
নয় তো কি, মাসি এলে আর একপালা রামায়ণ গান শুনবো বসে বসে? আমি তো বলেছি। ননীদা, তোমার যখন মুরোদ নেই তখন আর আমার চিন্তা করে করবে কি? আমার আত্মহত্যে ছাড়া গতি নেই। আর যদি তুমি হুকুম করো, মাসির হুকুমই মানি, তাহলে
কমলি! আচমকা একটা ধমক দিয়ে ওঠে ননী।
আর কমলি! কমলাও নিশ্বাস ফেলে।
মাইরি বলছি কমলি, এই শেষ চান্সটা নে। এরা খুব বড়লোক, তা ছাড়া বাবু হচ্ছেন দেশোদ্ধারী নেতা, একটা অপবাদ অপকলঙ্ক হলে আর মুখ দেখাতে পারবে না, দেশোদ্ধারের গয়াপ্রাপ্তি ঘটবে। সেই ভয়ে মুখবন্ধ করতে মোটা ঘুষ-ই দেবে মনে হচ্ছে।
আর যদি সেই মল্লিকবাবুদের মতন থানা-পুলিস করে?
আহা-হা, সে হলোগে একটা দৈবের ঘটনা। সেদিন পড়েছিলি একেবারে বাঘা কর্তার মুখে। একটু বুঝে সমঝে যেতে হবে।
মাসি আর রাজী হবে না।
সে ভয়ও আছে। এবারটার মতন বলেকয়ে রাজী করা। কিন্তু মাইরি বলছি তোকে কমলি–কেন কে জানে এবারের ছবিটা তুলে অবধি প্রাণের মধ্যে যেন কুলকাঠের আগুন জ্বলছে।
কেন বল তো? কৌতুক কৌতূহলে প্রশ্ন করে কমলা।
ওই তো বললাম, কেন কে জানে! বাবুটার সঙ্গে তোকে বড্ড বেশী ম্যাচ্ করেছে বলেই বোধ হয়!
বাবুটার সঙ্গে আমার, না ছবিটার সঙ্গে ছবির? বলেই সমস্ত দুঃখ ভুলে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে কমলা। বয়সের ধর্মই এই, সহসা কোনও কৌতুকে সব দুঃখ ভুলে হাসতে পারা।
তা বললে কি হয়, দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
কমলা তেমনি হাসিহাসি মুখে বলে, নিজেই তো বার করেছ বুদ্ধি, নিজেই তো করছে সব কৌশল।
করেছি কি আর সাধে! ননী উঠে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে কমলার একগোছা চুলে টান মেরে বলে, যা এখন চুলোয় আগুন ধরাগে যা, নইলে তো আবার মাসি এসে এখন তোর মুখে আগুন ধরাবে!
চলে যাচ্ছিল ননী। হয়তো বা ভুলে, হয়তো বা ইচ্ছে করে কমলা বলে ওঠে, তা কই, সে ছবি কই? যা নিয়ে তোমার এত হিংসে!
ও, ভুলেই যাচ্ছি! পকেট থেকে একটা খাম বার করে ননী। সন্তর্পণে তার থেকে একখানা বড় সাইজের ফটো বার করে। আর করবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখটা যেন দপ্ করে জ্বলে ওঠে তার। মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে, নে দেখ, দেখে চক্ষু সার্থক কর!
চক্ষু সার্থক মানে?
মানে আর কি, যুবরাজের পাশে যুবরানীর মতন দেখাচ্ছে তাই বলছি।
ধন্যি হিংসে বটে! তবু যদি সত্যি হতো!… আচ্ছা ননীদা, এত বেমালুম মেলাও কি করে। বল তো? বলে কমলা ছবিখানা চোখের সামনে তুলে ধরে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
একটি উজ্জ্বলদৃষ্টি সুকান্তি যুবকের মুখের পাশাপাশি একখানি ওড়নাটাকা নববধূর মুখ। সে মুখ কমলার নিজের। গলায় ফুলের মালা, কপালে টিলি, মুখে চন্দনরেখা।
কনে সাজলে এত সুন্দর দেখায় কমলাকে? আর পাশের মুখখানা বর না সেজেও কী সুন্দর! এযাবৎ এত লোককে ঠকিয়েছে কমলা, কিন্তু এত সুন্দর কাউকে নয়। মনটা মায়ায় ভরে ওঠে, ভারাক্রান্ত হয়ে আসে অপরাধ-বোধের ভারে।
সত্যি বল না ননীদা, এত পরিষ্কার মেলাও কি করে?
ওইটুকুই কৌশল! এতদিন যাবৎ ফটোগ্রাফের দোকানে কাজ করে আর ফটোগ্রাফি শিখে ওইটুকুই বিদ্যে হয়েছে।
কমলা আবারও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে ছবিটা।
ননী ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে ওঠে, দেখে দেখে যে আর আশ মিটছে না রে কমলি!
ধেৎ! কমলা ফটোখানা চৌকিতে ফেলে রেখে বলে, তোমার দেখছি আজ মেজাজ বড় খারাপ।
তা হবে। যাক চলি। ভাল কথা। বাবুর ঠিকানাটা রাখ। বলে ছেঁড়া চটিটা ফটফট করতে করতে চলে যায় ননী। জামার পিঠের সেলাইটা যেন নির্লজ্জভাবে দাঁত খিঁচিয়ে থাকে কমলার দিকে, যতক্ষণ দেখা যায়।
খানিকক্ষণ গুম্ হয়ে বসে থাকে কমলা, তারপর হঠাৎ একসময় চা ভেঙে উঠে পড়ে উনুনে আঁচ দিয়ে আসে। আর এসে ফের সেই ছবিখানাই তুলে নেয় হাতে।
সত্যি কমলা কি অভাগিনী! এমন দেবতার মত মুখওলা মানুষটার নামে মিথ্যে কলঙ্ক দিতে হবে তাকে।
ভারী রাগ আসে ননীর ওপর। কিছুতেই কেন কোন উপায় করতে পারছে না ননী? কমলার কেবলই মনে হয় ননী যদি তেমন চেষ্টা করতো, তা হলে বুঝি একটা উপায় হতো। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবিটাই দেখতে থাকে কমলা।
.
যথারীতি রৈ রৈ করতে করতে এল কেষ্টমোহিনী। হালা কমলি, উনুনটা যে জ্বলে পুড়ে খা হয়ে যাচ্ছে, ডালটা বসিয়ে দিতে পারিসনি?
কমলা অপ্রতিভ ভাবে বলে, আগুন ধরে গেছে?
গেছে না তো কি মিছে বলছি? বলি করছিলি কী এতক্ষণ?
করবো আবার কী!
কেষ্টমোহিনী ঘরে-ঢুকে পড়ে সন্দিগ্ধভাবে এদিক ওদিক তাকিয়েই চৌকির ওপর পড়ে-থাকা বড় খামটাকে দেখতে পায়। সেই ফটোর খাম। এ জিনিস তার পরিচিত। দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে কেষ্টমোহিনী–ছোঁড়াটা আবার এসেছিল বুঝি? ধন্যি বলি বেহায়া, এত গালমন্দ দিলাম, তবু লজ্জা নেই গো!
কমলা ম্লানভাবে বলে, বলে গেল, এই ফটো, এই ঠিকানা।
বলে গেল তো কেতাৰ্থ করলো! আমি তো তোকে ঝাড়া জবাব দিয়েছি কমলি, ও সবের মধ্যে আর নেই আমি। এ ঝুঁকি নিতেই বা যাব কেন?