না না, কেউ কমলাকে মনে করে নেই, কেউ কমলার কথা ভাবে না আর। সে-ঘর থেকে হারিয়ে গেছে কমলা। ইটকাঠের ঘর থেকে, মনের ঘর থেকে।
আশ্চর্য! জগতে এত মেয়ে আছে, সবাইয়ের মা-বাপ আছে, ভাইবোন আছে, পরিচয়ের একটা জগৎ আছে–নেই শুধু কমলার!
.
হ্যাঁ, হারিয়েও যায় অনেকে। বাংলা খবরের কাগজে এ রকম অনেক যে দেখেছে কমলা নিরুদ্দেশের পাতায়। কিন্তু হারিয়ে গিয়ে কমলার মত এমন খারাপ জায়গায় এসে পড়ে কেউ?
কেউ না। কেউ না। কমলার মত হতভাগী জগতে আর কেউ নেই।
বড় ইচ্ছে করে কোনও ভাল গণকারকে হাতটা একবার দেখায়! ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সব যিনি বলে দিতে পারেন হাতের ওই আঁকিবুকিগুলো থেকে! কমলার হাতের রেখা দেখেই বলে দেবেন কোথায় তার সেই জন্মদাত্রী মা, কোথায় তার আত্মীয়-পরিজন, কি তাদের ঠিকানা! বলে দেবেন কী নাম ছিল কমলার সেই আগের জন্মে, কেমন করে হারিয়ে গেল সে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে, আর কেমন করেই বা এখানে এসে পড়ল!
কিন্তু কোথায় তেমন ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষী? কে তার সন্ধান এনে দেবে কমলাকে? কে তার কাছে নিয়ে যাবে কমলাকে?
ননীদা বলে এরকম নাকি আছেন, কিন্তু ননীদা জানে না কোথায় আছেন। কাজেই সে শুধু স্বপ্নই থেকে গেছে। কমলার অতীতও অন্ধকার, ভবিষ্যৎও অন্ধকার।
আর বর্তমান? সে বুঝি একেবারে আলোকোজ্জ্বল? প্রতিনিয়ত অঙ্কুশের তাড়না, প্রতিনিয়ত যমযন্ত্রণা! মাসি যদি সর্বদা অমন কটু কাটব্যও না করত! যদি শুধু পাখী পোষা বেড়াল পোর মত কমলাকে শুধু পুষেই ক্ষান্ত থাকত!
.
কিন্তু তা হবার নয়। অহরহ পোষার খরচা উসুল করে নিতে চায় কেষ্টমোহিনী। অহরহ সেই একমুঠো ভাতের খোঁটা দিয়ে দিয়ে সচেতন করিয়ে দিতে চায় কমলাকে। কমলা বিদ্রোহ করতে চাইলে তীব্র ভাষায় স্মরণ করিয়ে দেয়,খাচ্ছিস পরছিস, ঘরতলায় মাথা দিয়ে আছিস, তার দাম নেই?
তাই দাম দিতে হয় কমলাকে। এক এক সময় ইচ্ছে হয় কমলার যেখানে দু চোখ যায়, চলে যায়। কিন্তু সাহস হয় না। কোথায় যাবে? কমলার বয়সী একটা মেয়ের পক্ষে পৃথিবী যে কী ভীষণ সে তো আর জানতে বাকি নেই তার। বড় দুঃখেই শিখেছে। দুঃখের বাড়া শিক্ষক নেই।
তা ছাড়া ননী! আহা ননী যদি একটা ফটোর দোকানেও কাজ পেত।
কী করে কোন্ ফাঁকে কার সঙ্গে না কার সঙ্গে মিশে ফটো তোলার কাজটা বেশ শিখে ফেলেছিল ননী, ছোট্ট একটা বক্স-ক্যামেরাও আছে তার। আছে ছবি প্রিন্ট করার মালমশলা। আর সকলের ওপর আছে ননীর ওই বিদ্যের সঙ্গে অদ্ভুত এক কৌশল। নইলে–
কী ভেবে আবার সেই ফ্রেমে বাঁধানো যুগল ছবিটা হাতে তুলে নিল কমলা।
আশ্চর্য…অদ্ভুত! কী করে করেছে? কে বলবে সত্যি কোন সদ্য বিয়ের বরকনের ছবি নয়? –সেই কনে হচ্ছে এই হতভাগী কমলা, আর বর এক দেবকান্তি রাজপুত্তুর।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন নেশার মত লাগে কমলার, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে থাকে। কিন্তু শুধু কি আজই? রোজই এমন হয়।
কী যে মোহিনী মায়া আছে ফটোটায়, দেখে দেখে যেন আর আশ মেটে না। দেখে দেখে শরীর অবশ হয়ে আসে, চোখ ফেটে জল আসতে চায়। লুকিয়ে তুলে রাখে, আবার এক সময় বার করে দেখে। ছবিটা নিয়ে এ এক মধুর রহস্যময় খেলা কমলার।
কী অপরূপ লাবণ্যে ভরা ওই মুখখানা, যে মুখ কমলার ছবির মুখের পাশাপাশি থেকে মানুষ কমলার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। গভীর গম্ভীর কোমল দৃষ্টি। এ দৃষ্টি যেন সকরুণ স্নেহে সমবেদনা জানায়, আবার অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে ফেলে ধিক্কার দেয়।
না, এত স্পষ্ট করে এত কথা ভাবতে জানে না কমলা, শুধু তার মনের মধ্যে অস্পষ্ট বাষ্পের মত এমনি একটা আনন্দ আতঙ্ক শ্রদ্ধা সমীহের অপরিচিত অনুভূতি পাক খেতে থাকে।
এ মানুষটাকে তো প্রত্যক্ষ দেখেছে কমলা, মাঝে মাঝেই দেখেছে, কই এমন বিভোর হয়ে যায়নি তো? কমলা কি এই ছবিটার প্রেমে পড়ে গেল নাকি? না, আগে যখন প্রত্যক্ষ দেখেছে, দেখেছে দূর থেকে। মানুষটা তখন সুদূর আকাশের তারা। জানতউজ্জ্বল ঝকঝকে সেই মানুষটা বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে বক্তৃতা দেয়, স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়, ওষুধ দেয়, পথ্যি দেয়, কেউ খেতে না পেলে তার ভাতের ব্যবস্থাও করে দেয়।
দেখেছে তাদের এই কলোনির মধ্যে ঘুরে ঘুরে নাইট-ইস্কুল বসাতে, রাস্তাঘাট ভাল করবার জন্যে কর্পোরেশনে দরখাস্ত দেবার জন্যে পাঁচজনের সইস্বাক্ষর জোগাড় করতে, দেখেছে অনেক লেখালেখি করে রাস্তায় দুদুটো টিউবওয়েল বসিয়ে দিতে।
ননীদা যখন এই লোকটার ফটো নিয়ে এসে বলেছিল, এই দেখ কমলি, মার দিয়া কেল্লা! আর একটি নতুন শিকার! কেমন স্পষ্ট পরিষ্কার ছবিখানা নিয়ে নিলাম, টেরও পেল না! মহা উৎসাহে লেকচার দিচ্ছিলেন বাবু, ভিড়ের মধ্যে কখন যে শ্রীযুক্ত ননীবাবু তাঁর দফা গয়ার ব্যবস্থা করে ফেললেন, জানতেও পারল না!.মনটা তখন খারাপ হয়ে গিয়েছিল কমলার। মনে হয়েছিল, আহা, অমন ভাল লোকটার নামে কালি দেওয়া? আর সে কালি লাগাবার ভার পড়বে। এই কমলির ওপরেই?
কিন্তু মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে কমলার লজ্জা করেছিল। শুধু বলেছিল, জানাজানি হলেই বা কী? যারা লেকচার দিয়ে বেড়ায় তাদের ফটো তত খবরের কাগজওলারাও নেয়!
তা নেয় বটে। সেই সাহসেই তো নিশ্চিন্তি হয়ে বুকে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াই।