কিন্তু কমলা জানে এ সমস্তই বানানো কথা। কোন নতুন লোকই আসেনি সেদিন। আর কমলা নিজে দেখেছে মরে যাওয়ার পরও লতিকার গায়ে তার সব গহনাই ছিল। প্রথমটা আচমকা চেঁচামেচি শুনে বাসার সব বাসিন্দে হুড়মুড়িয়ে ছুটে গিয়েছিল, কমলাও গিয়েছিল। কিন্তু তারপরই লতিকার মা আর দিদিমা চেঁচাতে লাগল, তোমরা সব ভিড় ছাড়ো গো ভিড় ছাড়ো, দেখি বাছার আমার জ্ঞানচৈতন্য আছে কিনা।
সকলেই একটু পিছু হটে এসেছিল, তার খানিক পরেই ফের পরিত্রাহি চীৎকার–ওগো কিছু নেই কিছু নেই, বিষে জরে গেছে বাছা আমার!
অতএব এবার তোমরা ভিড় করতে পারো।
কমলা দেখে তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল, লতিকার গায়ে সোনারত্তি বলতে কিছু নেই। আর লতিকার মা ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে, কোন্ নর-পিচেশ চামার এসেছিল গো, তুচ্ছ একটু সোনার লোভে আমার সোনার পিতিমেকে শেষ করে গেল!…ওরে তুই কেন চাইলিনে?
অবাক হয়ে গিয়েছিল কমলা এই অদ্ভুত মিথ্যা প্রচারে, অনেক হাঙ্গামার হাত এড়াতেই যে এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তেও এমন গল্প বানিয়ে ফেলল লতিকার মা, তা বুঝতে দেরি লেগেছিল কমলার।
কমলা বুঝেছিল, বিষ লতিকা নিজেই খেয়েছে। কমলার চাইতে বয়সে কিছু বড় হলেও মনের প্রাণের কথা কমলার কাছে বলত লতিকা। বলত, তুই-ই ধন্যি মেয়ে কমলি, ওই জাঁহাবাজ কেষ্টমাসির কাছেও খোট বজায় রেখেছিস। ইচ্ছে হয় যে তোর চন্নামেওর খাই। কী ঘেন্নার জীবন আমার! নিজের মায়ের কাছেও ছাড়ান নেই! মাঝে মাঝে মনে হয় কমলি, বিষ খেয়ে এ ঘেন্নার প্রাণ শেষ করে ফেলি!
কমলা সান্ত্বনা দিতে পারত না। শুধু মাঝে মাঝে বলত, কে জানে লতিকাদিও তোমার সত্যি মা কিনা! হয়তো তোমাকেও প্রফুল্লমাসি পয়সা দিয়ে কিনেছে! আমার যেমন মাসি, তোমার তেমন মা!
হয়তো এইটুকুর মধ্যেই রাখতে চাইত অনেকখানি সান্ত্বনা। যে মানুষটা লতিকার মর্মান্তিক অপমানের মূল সে অন্তত লতিকার মা নয়, লতিকা নিজে নয় এই কুৎসিত কুলোব! এই শুধু, এর বেশি আর কী দিতে পারবে কমলা।
লতিকা কিন্তু বিষণ্ণ হাসি হাসত। মাথা নেড়ে বলত, দূর, মা দিদিমা সব আমার চিরকালের। তাই তো ভাবি কমলি, তোর তবু মনে একটা সান্ত্বনা আছে–তোকে কিনে এনে চুরি করে এই নরকে এনে ফেলেছে, কিন্তু আমার যে ওপর ভেতর আগুনের জ্বালা! এই নরকেই আমার উৎপত্তি যখন ভাবি তখন মনে হয় গলায় ছুরি দিই, বিষ খাই, জলে ঝাপাই কি আগুনে পড়ি!..তাই কি স্বাধীনতা আছে? চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা!…মা নামে আমার ঘেন্না কমলি!
.
লতিকার এ মৃত্যু যে আত্মহত্যা, এতে আর সন্দেহ ছিল না কমলার। হয়তো কমলাও কবে কোনদিন এমনি করে নিজেকে শেষ করে ফেলত, যদি না ননীদা…ননীদা-ই জব্দ করে রেখেছে কমলাকে।
কিন্তু আর কতদিন এই কাঁটাবনের মাঝখান দিয়ে হাঁটবে কমলা? কবে পাবে সত্যিকার একটা পথ? যে রকম পথ দিয়ে সত্যিকার মানুষরা হাঁটে।
.
এ বাড়িতে আরও কত ঘটনাই ঘটে, যা কমলা বোঝে কোনও সত্যিকার মানুষদের সংসারে ঘটে না, কিছুতেই ঘটতে পারে না। মন গ্লানিতে ভরে আসে, ক্লেদাক্ত হয়ে ওঠে, তবু এই পরিবেশের মাঝখানেই পড়ে থাকতে হয় কমলাকে।
তাই না নিজেকে কিছুতেই সত্যিকার মানুষ ভাবতে পারে না কমলা। একা বসে থাকলেই
স্মৃতির অতল তলায় তলিয়ে গিয়ে, ডুবে যাওয়ার মতই রুদ্ধশ্বাস বক্ষে মনে আনতে চেষ্টা করে কমলা সেই তার অজ্ঞাত শৈশবকে!…কী ছিল সে? কে ছিল? কাদের মেয়ে? নির্মল পবিত্র সত্যিকার কোন মানুষদের!
.
হয়তো পথেঘাটে এখানে সেখানে কমলার সেই পূর্বজন্মের মা বাপ ভাইবোনেরা কমলারই সামনে দিয়ে হাঁটছে চলছে বেড়াচ্ছে। কমলা চিনতেও পারছে না। তারাও তাকিয়ে দেখছে না তাদের এই একদা হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার দিকে। আর তাকিয়ে দেখলেই বা কী! চিনতে পারবে নাকি? গল্প উপন্যাসেই শুধু দেখা যায় সেই গল্পের মানুষরা অনেক…অনেক বছর পরে তাদের হারানো ছেলেমেয়েদের সন্ধান পায়, দেখা হয়। মিলন হয়। সব ফাঁকি, সব বাজে, মানুষের জীবনে ও রকম কিছু হয় না।
তবু মাঝে মাঝে নিতান্ত সস্নেহে কমলা তার ডান হাঁটুর নিচের ছোট্ট জড়লের দাগটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। এই রকম একটি তিল কি জড়ল চিহ্ন ধরেও নাকি অনেক সময় পরিচয় প্রমাণিত হয়।
.
আচ্ছা, কমলা যখন হারিয়ে গিয়েছিল তখন তার সেই জন্মদাত্রী মা কী করেছিল? শুধু দুচারদিন কেঁদেছিল? শুধু দুচারদিন হায় হায় হায় করেছিল?–ব্যস্, তারপর ছোট্ট মেয়েটাকে ভুলে গিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে খেয়েছে ঘুমিয়েছে বেড়িয়েছে, অন্য ছেলেমেয়েদের আদরযত্ন করেছে।
এই কথাটা ভাবতে গেলেই বুকের মধ্যে হু-হুঁ করে ওঠে কমলার, ছলাৎ করে এক ঝলক জল এসে যায় চোখের কোণায়। একই ঘরে জন্মে তারা কত সুন্দর পবিত্র আর কমলা ছিটকে এসে পড়েছে কী পাঁকের মধ্যে!
মাঝে মাঝে অন্য ছেলেমেয়ে-হীন একটি ঘরের ছবি কল্পনা করতে চেষ্টা করে কমলা। শূন্য ঘর খাঁ খাঁ করছে, আর আজও একমাত্র সন্তানহারা দুটি প্রাণী কেঁদে কেঁদে মাটি ভিজোচ্ছে!… হয়তো বুকে করে তুলে রেখেছে ছোট্ট একজোড়া লাল জুতো, ছোট্ট দুএকটি ফ্রক পেনি! কিন্তু এ কল্পনায় জোর পায় না কমলা। তেমন হলে কি আর তারা খুঁজে বের করত না তাদের সেই হারানো মানিককে? স্বর্গ মর্ত্য পাতাল তোলপাড় করে?