নিয্যস বিকেলবেলা যে মাগী একটা ছুঁড়ি আর একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে এসেছিল, এ সেই তাদেরই কারসাজি। একটা কোন অঘটন ঘটেছে কোথাও কোনখানে।
.
চন্দ্রনাথ এগোতে এগোতে ভাবছেন, জীবনের কোন্ ঘটনাটা মানুষের অজ্ঞাত নয়? এই যে চন্দ্রনাথ এখন এই গভীর রাত্রির নির্জনতায় একা চলেছেন, এ কি কিছুক্ষণ আগেও ভাবতে পেরেছিলেন? কোনদিনই কি ভাবতে পারতেন, রাত বারোটায় একা একা পথ চলছেন চন্দ্রনাথ–হেঁটে হেঁটে, গায়ে গেঞ্জি, পায়ে চটি!
.
চলতে চলতে সহসা মনে হল এই যে এগিয়ে যাচ্ছেন, এটা যেন চন্দ্রনাথের সারা জীবনেরই একটা প্রতীক। সমস্তটা জীবন তো এমনি করেই পার হয়ে এলেন চন্দ্রনাথ, নিঃসঙ্গ নির্জন। জীবনের লক্ষ্য? তাই বা কই? কবে কি ভেবেছেন তেমন করে? ছেলেটাকে, একমাত্র সন্তানকে একটা মানুষের মত মানুষ করে তুলব, এমন কোন আদর্শ কি কখনো চন্দ্রনাথের মধ্যে কাজ করেছে?
-না, মনে করতে পারলেন না। ছেলেকে প্রাণভরে ভালই বেসেছেন, তার সম্পর্কে চিন্তা করেননি কোনদিন।
অর্থোপার্জন? সেটাই কি জীবনের লক্ষ্যবস্তু ছিল চন্দ্রনাথের? তাই বা বলা যায় কই? উপার্জন অবশ্য করেছেন প্রচুর, কিন্তু সেটা পরম একটা লক্ষ্য হিসেবে কি? নিঃসঙ্গ জীবনে কর্মের একটা নেশা ছিল, তাই কর্মক্ষেত্রে চলে এসেছেন নির্ভুল নিয়মে, এবং তার পুরস্কার যথেষ্ট পেয়েছেন এই পর্যন্ত।
খুব বড়লোক হবো, সমাজের উঁচু চুড়োয় উঠে বসব, এ সব সখসাধ চন্দ্রনাথের কখনো ছিল না। কাজ দিয়ে ভরে রাখা মন ঘরে ফিরে এসে চেয়েছে একটু বিশ্রাম, একটু আরাম, একটু শান্তি। পেয়েছেন সেটুকু, ব্যস আর কি? আর কী চাইবার আছে জীবনে?
এইটুকু যে পাচ্ছেন তার জন্যই যেন কৃতজ্ঞতা বোধের অন্ত নেই। ভগবানের প্রতি, সংসারের প্রতি, সর্বোপরি নীহারকণার প্রতি এক অপরিসীম কৃতজ্ঞতা নিয়ে জীবনটাকে কাটিয়ে দিলেন। সে জীবনে আর কিছু চাইবার আছে এটাও যেমন কোনদিন অনুভব করেননি, তেমনি খেয়াল করেননি, তাঁর আরও কিছু করবার আছে।
আজ এই নির্জন রাস্তায় চলতে চলতে মনে হল চন্দ্রনাথের আরও কিছু করবার কিছু।…ছিল ছেলেকে জানবার।
.
অনেকক্ষণ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যখন চন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে এলেন, তখন আর একবার মনে হল তার অন্তত এতটুকুও জেনে রাখবার ছিল, ইন্দ্রনাথের সমিতির ঠিকানা কী? স্থির বিশ্বাস সেখানেই গেছে! নইলে?…আত্মহত্যা?
না, নীহারকণার মতো অতটা দূর পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারছেন না চন্দ্রনাথ।
আজ রাত্রে আর কোন উপায় নেই। কাল, হা কাল বেলা দশটার পর খোঁজ করবার হদিস মিলতে পারে। যেখানেই চলে যাক রাগ করে, হয়তো অফিসে আসবে। মন বলছে খবর সেখানেই পাওয়া যাবে। সত্যিই তো আর জীবনটা মঞ্চের নাটক নয় যে, এইমাত্র যে ছিল সে চললাম বলে চলে গেল–আর জীবনে তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
.
ননী চলে যাওয়ার পর কমলা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল চৌকিটায়। ননীর জন্যে মনটা মমতায় গলে যাচ্ছে। কী বেচারী লোকষ্টা! সামান্য একটা চাকরির জন্যে মাথা কুটে ফেলছে, তবু জুটছে না!
জুটবেই বা কী করে, বিদ্যে-সাধ্যি না থাকলে কি আর এ যুগে কাজ জোটে? শুনতে পাওয়া যায় আগেকার আমলে নাকি কানাকড়ার বিদ্যে সম্বল করে মস্ত মস্ত অফিসের বড়বাবু হত। একালে পাস না করলে অফিসের পিয়নটি পর্যন্ত হবার জো নেই।
বেচারী ননীদা শুধু জমা দেবার টাকার অভাবেই নাকি একটা পাস দিতে পারেনি! কমলার সঙ্গে ভাগ্য জড়িত করতে চেয়েছে বলেই বুঝি ননীর এই দুর্ভাগ্য!
ননী অবশ্য সে কথা মানে না। সে বলে ভাগ্যকে সে এখনি ফিরিয়ে তুলতে পারে, যদি সামান্য কিছুও মূলধন জোটাতে পারে। ব্যবসার ঝোঁক তার, বলে ছোট্ট একটু ব্যবসা থেকেই কত বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বলে কমলাকে একবার ঘরে পুরে ফেলতে পারলেই চঞ্চলা কমলা উথলে উঠবেন তার সংসারে! শুধু সামান্য একটু মূলধন!–কিন্তু কোথায় সেই সামান্যটুকুও?
.
কমলা যে ঘেন্না-লজ্জার মাথা খেয়ে লোক ঠকিয়ে অপবাদ অপমান মাথায় বয়ে উপার্জন করে আনে, তার থেকে কি একটা টাকাও হাতে পায়?
না, কমলাকে কেষ্টমোহিনী পাইপয়সাটিও দেয় না। অথচ সত্যিই কিছু আর সব টাকা কমলার ভাত-কাপড়ে যায় না।
তা সেদিক থেকে তো দেখে না কেষ্টমোহিনী, দেখে অন্য দিক থেকে। তার মতে কেষ্টমোহিনীর নির্দেশক্রমে চললে যে টাকাটা ঘরে আনতে পারত কমলা, (কেষ্টমোহিনীর মতে সেটা হচ্ছে মোট মোট টাকা) সেই টাকাটা অবিরতই লোকসান যাচ্ছে। অতএব কমলার দ্বারা যে টাকা রোজগার হচ্ছে, সেটা কিছুই নয়। ত আর তার থেকে ভাগ চাইবে কমলা কোন ধৃষ্টতায়?
.
উঠতে বসতে কেষ্টমোহিনীর গঞ্জনা, ননীর ওই হতাশ ম্লানমুখ, আর প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রতারণার জাল ফেলে ফেলে টাকা উপায়ের চেষ্টা, এ যেন কমলার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। কোথায় আলো…কোথায় পথ…?
যদি তার জীবনে ননী না থাকত, যদি না থাকত ননীর ভালবাসা, তাহলে হয়তো কবেই এই জীবনটাকে শেষ করে দিত কমলা গলায় দড়ি দিয়ে কি বিষ খেয়ে। সে ধরনের মৃত্যু কমলা জ্ঞানাবধিই দেখছে। এই তো এই বছরখানেক আগে লতিকা মলো বিষ খেয়ে। সে কী কাণ্ড!
পুলিস এল, বাড়িসুষ্ঠু সকলের সাক্ষী নেওয়া হল, লতিকার মাকে ধরে নিয়ে থানায় চলে গেল, কত ঝঞ্জাট। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই প্রমাণ করা হয়েছিল সেই দিনই অর্থাৎ সেই রাত্রেই একটা অজানা অচেনা লোক এসেছিল লতিকার কাছে, সেই নরপিশাচটাই লতিকার গায়ের গহনার লোভে বিষ খাইয়ে সব নিয়ে-থুয়ে সরে পড়েছে। সেই প্রমাণেই লতিকার মা ফিরে এল থানা থেকে, আর চীৎকার করে কাঁদতে বসে, ওরে কে আমার এমন সর্বনাশ করল রে, আমার সোনার পিতিমেকে বিষে নীল করে দিয়ে গেল রে–