.
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে খুব খানিকটা এলোমেলো ঘুরে একটা বাড়ির বোয়াকে বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ। হলেও শহর কলকাতা, তবু রাত সাড়ে বারোটায় অকারণ অজানা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সমীচীন নয়। পুলিসের চোখে যদিও বা না পড়ে, চোরের চোখে পড়ে যেতে পারে। হাতে দামী ঘড়ি, দু আঙুলে দুটো মূল্যবান পাথরের আংটি, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, পকেটেও মুঠোখানেক টাকা।
মনটা চঞ্চল হল। যতক্ষণ রাস্তায় হাঁটছিল ততক্ষণ চিন্তার ধারাবাহিকতা ছিল না, শুধু একটা দুরন্ত বিস্ময়, আর একটা অপরিসীম অপমানের জ্বালায় সমস্ত মনটা জুলছিল। এখন মনে হল চলে আসাটা যেন বড্ড বেশী নাটকীয় হয়ে গেছে।
ঠিক যেন সিনেমার কোন নায়কের ভূমিকা নিয়েছে ইন্দ্রনাথ। সত্যি, পিসিমা মেয়েমানুষ আর বাবা হচ্ছেন ভালমানুষ। কে কোন্ শয়তানির জাল বিস্তার করতে কী না কী বলে গেছে, বিশ্বাস করে বসেছেন।
তবু রাগ হয় বৈকি! ইন্দ্রনাথকে একবার জিজ্ঞেস করবারও প্রয়োজন বোধ করবেন না? অবাক হয়ে বলবেন না,এরা কে বল তো ইন্দু? তোকে ফাঁদে ফেলবার তালে বেড়াচ্ছে নাকি?
সত্যি!…কে তারা?
কে তারা? কী অদ্ভুত কথা বলতে এসেছিল! কত রকম প্রতারকের কত রকম প্রতারণার ভঙ্গি আছে এই কলকাতা শহরে, এও হয়তো তারই কোন এক নমুনা!
কিন্তু আশ্চর্য, ফটো পেল কোথায়? জীবনে কবে কোনদিন কোনো মেয়ের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফটো তুলেছে ইন্দ্র?
পিসিমার চোখে কি মন্ত্রপড়া ধুলোপড়া দিয়ে ধাঁধা লাগিয়ে গেল? চিনতে ভুল করলেন পিসিমা? ইন্দ্রর মুখ চিনতে পিসিমা ভুল করবেন?
কিন্তু কী আপসোস! কী আপসোস, সেই হতচ্ছাড়া সময়টাতে ইন্দ্র বাড়িতেই উপস্থিত ছিল, স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেনি সেই মুহূর্তে তার ঘরের কয়েক গজ দূরেই মৃত্যুবাণ রচিত হচ্ছে তার জন্যে।
পিসিমা যদি পর্দার অন্তরালে বসে না থাকতেন! যদি একবারের জন্যে বেরিয়ে এসে খোঁজ করতেন ইন্দ্র ফিরেছে কিনা। যদি বলতেন ওরে ইন্দু, এসে দেখ তো এদের চিনিস কিনা?
ইন্দ্র যে তার নিজের সংসারে লাঞ্ছিত হল, অপমানিত হল, বিচ্যুত হয়ে এল–এ সমস্ত অনুভূতি ছাপিয়েও অসহ্য একটা বিস্ময় ক্রমশ গ্রাস করছিল তাকে, কে সেই মেয়ে!
কে সেই মেয়ে? যে মেয়ে চোখের জলে ভেসে বলে, এই ছবিই তার সম্বল! সোনার হার প্রত্যাখ্যান করে সেই ছবির বদলে! প্রতারকের প্রতারণাই যদি, তবে এমন কেন?
নগদ একশ টাকা আর মাসোহারার প্রতিশ্রুতিটা নীহারকণা ইন্দ্রর কাছে বলবার অবকাশ পাননি, তাই হিসেব মিলোতে পারে না ইন্দ্র।…জুয়াচোর যদি তো সোনার হার নেয় না কেন?
আরও কিছুক্ষণ চিন্তার অতল গভীরে ডুবে যায় ইন্দ্র।
কী কুৎসিত আর কী অদ্ভুত অপবাদ! ইন্দ্রনাথের আকৃতিধারী শিশুসন্তান নাকি তার কাছে। কী লজ্জা, কী লজ্জা!
বাবা শুনেছেন! লজ্জায় ঘৃণায় একা অন্ধকারে কানটা ঝা ঝাঁ করে ওঠে ইন্দ্রনাথের। তারপর খানিকক্ষণ পর সবলে মনের সমস্ত জঞ্জাল সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
.
এখন রাতের আশ্রয় ঠিক করা দরকার। হঠাৎ মনে পড়েছে আগামীকাল অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে। যথানির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতেই হবে। এলোমলো হয়ে পড়লে চলবে না।
রাতের আশ্রয়! কিন্তু শুধুই কি আজকের এই অদ্ভুত রাতটার জন্য আশ্রয়? সারা জীবনের জন্য নয়? আচ্ছা চিরদিনের সেই আশ্ৰয়টা সত্যিই চিরদিনের মত ত্যাগ করে এল সে?
সে রকম ভয়ংকর একটা অনুভূতি কিছুতেই মনে আনতে পারছে না ইন্দ্র। চেষ্টা করে ভাবতে গিয়েও কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। শুধু সাময়িক একটা অসুবিধে বোধ ছাড়া বিশেষ কোনও বোধ নেই।
কিন্তু এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে ইন্দ্র? এমনিই তো হয়। ভয়ংকর একটা ক্ষতি, প্রাণের প্রিয়জনকে হারানোর শোক, কিছুই কি ঠিক সেই মুহূর্তে অনুভব হয়? তখন কি চেষ্টা করে করে মনে আনতে হয় না–আমার সর্বস্ব গেল…আমার সর্ব গেল!
ক্ষতির অনুভূতি আসে দিনে দিনে, তিলে তিলে, পলে পলে।
তাই ইন্দ্রনাথ যতই মনে করতে চেষ্টা করে করুক, আমার আর নিজস্ব কোন আশ্রয় নেই, আমি গৃহচ্যুত সংসারচ্যুত, আমি নিঃসঙ্গ আমি একা–ঠিক এই মুহূর্তে সেই সত্যটা সম্পূর্ণ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয় না।
উঠে পড়ে ভাবে–দেখা যাক, সমাজকল্যাণ সঙ্ঘের কার্যালয়ের চাকরটাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে টেনে তোলা যায় কিনা। আজ রাতটা তো কার্যালয়ের অফিসঘরের সেই সরু চৌকিটায় স্থিতি। তারপর আছে ভাগ্য আর ভবিষ্যৎ।
.
নীহারকণার নির্দেশে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন চন্দ্রনাথ, কিন্তু বেরিয়ে পড়ে এমন মনে হল না যে কোনও পলাতক আসামীকে দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলবার জন্যে বেরিয়েছেন তিনি। বরং উল্টোই মনে হল। মনে হল চন্দ্রনাথ নিজেই বুঝি কোথাও চলে যাচ্ছেন। উধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া নয়, অন্যমনস্কভাবে কোনও লক্ষ্য স্থির না করে শুধু আস্তে আস্তে এগিয়ে যাওয়া। চাকরবাকরগুলো আসছিল পিছনে, হাত নেড়ে বাড়ি ফিরে যাবার ইশারা করলেন তাদের চন্দ্রনাথ, তারপর এগোতেই লাগলেন।
চাকরগুলো অন্ধকারেই রয়ে গেল। পিসিমার আচার-আচরণ দেখে মনে হচ্ছে দাদাবাবুর কথাই ঠিক হঠাৎ মাথা গরম-ই হয়েছে আর দাদাবাবু ডাক্তার আর বরফ আনতে গেছে। কিন্তু বাবুর আচরণ দেখে তো ঠিক তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এর ভিতরে কোনও রহস্য বর্তমান। কিন্তু কী সেই রহস্য?